কয়েক মাস আগে দক্ষিণ কলকাতার এক বিয়েবাড়ির ঘটনা।
পুরোহিতমশাই বিয়ের মন্ত্রোচ্চারণ করে চলেছেন। কিন্তু বিয়ে করতে বসা পাত্র সংস্কৃত মন্ত্রে প্রতি মুহূর্তে ঠোক্কর খাচ্ছেন। উচ্চারণ বুঝতে পারছেন না। বারবার জিজ্ঞেস করছেন, ‘‘কী বললেন আর এক বার বলবেন ঠাকুরমশাই?’’
কয়েক বছর আগে মহালয়ার দিন। গঙ্গায় তর্পণ করতে এসেছেন এক প্রৌঢ়। সেখানে পুরোহিত মন্ত্রোচ্চারণ শুরু করতেই প্রৌঢ় চিৎকার করে উঠলেন “কী মন্ত্র পড়ছেন! এ তো শ্রাদ্ধের মন্ত্র!”
মন্ত্রোচ্চারণ নিয়ে অনেককেই এমন নানা অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়। স্বাভাবিক ভাবেই আঙুল ওঠে পুরোহিতদের দিকে। সঠিক মন্ত্রোচ্চারণের প্রশিক্ষণ দিতে এ বার পুজোর আগে পুরোহিতদের নিয়ে বিশেষ কর্মশালা চালাচ্ছে ‘সর্বভারতীয় প্রাচ্যবিদ্যা অ্যাকাডেমি।’ ১৯৯৪ সাল থেকে প্রতি বছরই এই কর্মশালা আয়োজিত হয়ে আসছে। কিন্তু এ বছর তার চরিত্র বদলেছে। শুধু পুরোহিত নয়, শিবিরে আসতে শুরু করেছেন অন্য পেশার মানুষও।
অন্য পেশা মানে? কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ বহুজাতিক কম্পিউটার সংস্থার কর্মী, কেউ চিকিৎসক, আবার কেউ অবসরপ্রাপ্ত ব্যাঙ্ক কর্মী। এঁদের কেউই পুরোহিতের কাজ করবেন না। কেউ কেউ হয়তো নাস্তিকও। তবু এঁরা এসেছেন সংস্কৃত ভাষাটা ভাল করে জেনে ভারতীয় শাস্ত্রের মর্মোদ্ধারের জন্য। অনেকে এসেছেন বাংলাদেশ, এমনকী সুদূর আমেরিকা থেকেও। |
কীসের টানে জড়ো হচ্ছেন এঁরা? অর্ক চট্টোপাধ্যায় যেমন পেশায় একটি বেসরকারি মাল্টি-মিডিয়া সংস্থার সঙ্গে যুক্ত। তিনি বললেন, “পুজো বা অন্যান্য অনুষ্ঠানে পুরোহিত যা বলেন, সেই মন্ত্রই বলে যাই। কিন্তু সংস্কৃতে একটি অক্ষরের উচ্চারণের এদিক-ওদিক হলে তার মানে বদলে যায়। ঠিক উচ্চারণ, ঠিক মানে জানার জন্যই এখানে আসা।”
আর এক শিক্ষার্থী বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজের হোমিওপ্যাথির শিক্ষিকা। তাঁর কথায়, “বাড়িতে পুজোর পরিমণ্ডল থাকায় পুজো বা ধর্ম সংক্রান্ত বই পড়ি। কিন্তু সংস্কৃত না জানায় ভারতের প্রাচীন শাস্ত্রগুলি অনুবাদে পড়তে হত। তা ছাড়া, যে মন্ত্র আমরা বলি, সেগুলি ঠিক কী বলতে চাইছে, তার মানেটা তো জানা দরকার!”
সেই লক্ষ্যেই এই শিবিরে আসা। অ্যাকাডেমির অধ্যক্ষ জয়ন্ত কুশারীও বলছেন, “অধিকাংশ লোকই পুরোহিত যে রকম বলেন, সেই রকম মন্ত্র আউড়ে যান। সংস্কৃত জানলে মন্ত্রের প্রকৃত অর্থ বোঝা যায়। অর্থ জানলে দেখা যাবে, এত বছর পরেও তাদের কার্যকারিতা অটুট।”
কলকাতাতেই সংস্কৃত প্রশিক্ষণের আরও শিবির আছে। যেমন ভারত সংস্কৃত পরিষদ। সেখানকার এক উদ্যোক্তা আচার্য কমলাকান্ত বললেন, “আমাদের শিবিরে মূলত পুরোহিত এবং পুজোয় অন্যান্য কাজ যাঁরা করেন, তাঁরাই আসেন। মন্ত্র উচ্চারণ পদ্ধতি এবং পুজোর আয়োজনে যাতে কোনও ত্রুটি না হয়, সেই উদ্দেশ্য নিয়েই এই শিবিরের আয়োজন।”
এই ধরনের শিবির কি সংস্কৃত ভাষাচর্চার কোনও প্রসার ঘটাবে? কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের প্রধান রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বলেন, “এই মুহূর্তে প্রকৃত সংস্কৃত জানা পুরোহিত কমে গিয়েছে। এই ধরনের শিবিরে তাঁরা উপকৃত হবেন।” বিশ্ববিদ্যালয়ে বহু ছাত্রছাত্রীই আসেন সংস্কৃত শেখার জন্য। কিন্তু ভাল করে এই ভাষার দখল নিতে গেলে যে পরিকাঠামো দরকার, তা এ রাজ্যে নেই বলে অভিযোগ রবীন্দ্রবাবুর। তাই প্রাচীন এই ভাষা টিমটিম করে হলেও বাঁচিয়ে রাখতে এ ধরনের শিবিরও বড় ভরসা বলে তাঁর মত। |