ইঞ্চি দুয়েকের একটা ব্লেডের দাগ। এখনও টাটকা। সুস্মিতার কাছে ঠিক তেমনই তাজা সে রাতের ট্রেনের ভয়ংকর স্মৃতিটা।
না। ‘সিআইডি’র এপিসোড নয়। রূঢ় বাস্তব।
রাত ১০:২০। আপ ব্যান্ডেল লোকাল হাওড়া ছাড়ছে। লেডিস কামরায় হাতে গুনে সাত আট জন। বেশির ভাগই অফিস-ফেরতা। জানলার ধারে বসে ফোনে কথা বলছিলেন সুস্মিতা ঘোষ। হঠাৎ হাতে একটা হ্যাঁচকা টান। চিনচিনে ব্যথা। রক্ত। বছর কুড়ির একটা ছেলে। হিংস্র চাহনি। কাড়তে চাইছে ওঁর ফোনটা। ভয়ের রেষ কাটিয়ে উঠতেই একটা জেদ। দাঁতে দাঁত চেপে চোরের সঙ্গে হাতাহাতি।
চমকে উঠলেন?
হ্যাঁ, আহত হওয়া কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ছাত্রী সেদিন রীতিমতো লড়াই করেই নিজেকে বাঁচাতে পেরেছিলেন। খবরের কাগজে, টিভিতে যখন হামেশাই শিরোনামে উঠে আসছে মেয়েদের নাকাল হওয়ার ঘটনা তখন সুস্মিতার এই অভিজ্ঞতা আশঙ্কার পারদটাকে আরও একটু চড়িয়ে দেয়।
কারণ? বিপদ যে এখন আরও কাছে। আরও প্রকাশ্যে। খোদ ট্রেনের ভেতরে। তাই হাওড়ার মতো জনবহুল স্টেশনেও মহিলা যাত্রীদের রাতে একা যাওয়া ‘ডেঞ্জারাস’।
একটু রাত হলেই মহিলা কামরা খালি হতে থাকে। আর তখনই ‘টার্গেট’ হয়ে যায় বিভিন্ন অসামাজিক কাজকর্মের। “মাঝেমাঝেই পুলিশ থাকে না। থাকলেও ওদের নাকের ডগাতেই ঘটে যায় কত কী”, অভিযোগ কলসেন্টারে কর্মরতা সুরভি পাণ্ডের। শেষের কথাতে মুখটা হাঁ হয়ে গেল। তা দেখেই শুরু ...
তিনি যাচ্ছিলেন গুড়াপ। ধনেখালিতে মহিলা কামরা প্রায় খালি। দুটো ছেলে উঠল। শুরু হল সুরভিকে নিয়ে অশ্লীল মন্তব্য। পুলিশের বকাঝকা খেয়ে পরের স্টেশনে ছেলেদুটো নেমে গেল। কিন্তু ট্রেনটা ছাড়তেই জানলা দিয়ে কিছু একটা ছিটকে এল। গরম কিছু। গন্ধওয়ালা। “সুপুরির পিক। পুরো গা-টা গুলিয়ে উঠল। কানে এল প্ল্যাটফর্ম থেকে ছেলেগুলোর হাসি।” হতবাক পুলিশ সেদিন কিছুই করতে পারেননি! সুরভিও ‘মার্কড’ হয়ে যাওয়ার ভয়ে কোনও রিপোর্ট লেখাননি। |
সে কথাতেই হাওড়া জিআরপি অফিসের বিশ্বনাথ মল্লিক বললেন, “আমাদেরকে না জানালে কীসের বেসিসে অ্যাকশন নেব বলুন। আমরা চেষ্টা করছি এই সব অ্যান্টিসোশ্যাল কাজকর্মকে নির্মূল করতে। কিন্তু তার জন্য আপনাদেরও তো সহযোগিতা করতে হবে।” এই ‘চেষ্টা’র আশ্বাস থাকা সত্ত্বেও কিন্তু পুলিশকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে রাতের ট্রেন আর স্টেশন চত্বরে দিব্যি চলছে অসামাজিক কাজকর্ম। “কিছু কিছু নির্দিষ্ট স্টেশন তো রীতিমতো কুখ্যাত চুরি, ছিনতাই বা ইভটিজিংয়ের জন্য! যেমন ধরুন পার্ক সার্কাস স্টেশন”, বলে উঠলেন শিয়ালদহ লাইনের নিত্যযাত্রী মাধবী বর্মন। সেখানে চুরি-চামারি ছাড়াও থাকে মহিলা ছিনতাইবাজরা।
ঠিকই শুনেছেন। মহিলা। এবং ছিনতাইবাজ। বাজারের ঝুড়ি নিয়ে ওঠে। দরজা আটকে দাঁড়ায়। ভয় দেখিয়ে মোবাইল থেকে সোনার চেন ছিনতাই। এই মহিলাদের ভয়েই শিয়ালদহ দক্ষিণের ট্রেনের মহিলা যাত্রীরা এড়িয়ে যান রাতের মহিলা কামরাকে! ছুটতে হয় সাধারণ কামরার ভিড়ে।
অফিস টাইমে সাধারণ কামরায় মহিলাদের হয়রানির ঘটনা আমাদের জানা। তবে বেশি রাতে যখন ভিড় থাকে না, তখন এই সাধারণ কামরাই কিন্তু হয়ে ওঠে মহিলাদের ত্রাতা। সাহায্য করতে পুরুষ যাত্রীরা থাকেন প্রস্তুত। তাঁরাই মনে করেন রাত দশটার পর মেয়েদের জন্য মহিলা কামরা খুব একটা নিরাপদ নয়। “জেনারেলে কেউ কিছু করতে গেলে তার কপালে সত্যিই দুঃখ আছে!” অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে এমনটাই দাবি করলেন বছর পঁচিশের অর্ক দাস।
বারবার চলেছে রাতের ট্রেনে মহিলাদের ওপর নানা রকমের হামলা। কখনও বারাসত কখনও পার্কসার্কাস। তবু কামরায় কোনও মেয়েপুলিশ থাকেন না। থাকে না যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থাও। তাই হয়ে ওঠে না ক্লান্ত শরীরটাকে সিটে এলানো। ফাঁকা ট্রেনের জানলার ধারে বসে একটু হাওয়া খাওয়া। সব সময় একটা চোরা ভয়। এই বুঝি কিছু হল।
স্টেশন চত্বরে মদের ঠেক, জুয়ার আড্ডাখানা। টিউশন-ফেরত ছাত্রছাত্রীরা ভয়ে তটস্থ। চিন্তিত বাবা-মা রাও। সব কাজ ফেলে দৌড়ে আসতে হয়। পাহারা দিয়ে নিয়ে যেতে বাড়ির ছেলে-মেয়েদের। আর ছোট স্টেশনগুলোর তো কথাই নেই!
বৈদ্যবাটি স্টেশনে বারো কোচের ট্রেনে লেডিস কামরা পড়ে এক প্রান্তে। সেখানে পুলিশ পাহারা তো দূরের কথা, আলোই থাকে না!
কিছু দিন ধরেই এই প্ল্যাটফর্মে চুরি ছিনতাইয়ের অভিযোগ। স্টেশন চত্বরে মেয়েদের কুপ্রস্তাব। শ্লীলতাহানির চেষ্টা। সেই রোড ধরেই যাচ্ছিলাম। হঠাৎ সামনে একটা কমবয়সী ছেলে। খোলা ছুরি মুখের সামনে ধরে বলছে “যা আছে বের কর”। পেশায় সাংবাদিক। অনেক কিছুই ‘কভার’ করতে হয়। কিন্তু আজ বিপদকে এত সামনে দেখে বুক কেঁপে উঠল। নিজেকে সামলেই জোর চিৎকার। ছুরির ঘা উপেক্ষা করে ছেলেটাকে ধরার চেষ্টা। ধস্তাধস্তি।
কোনও সাহায্যের হাত সেদিন এগিয়ে আসেনি। আসেও না। ভয়টা তাই থেকেই যায়। এটা নিত্য-নৈমিত্তিক একটা সমস্যা।
অথচ প্রতিকারের ভার যাদের উপরে, সেই রেলপুলিশের কাছে নাকি কোনও অভিযোগই আসে না। “এই আপনি বললেন তাই জানতে পারলাম। আমাদের কাছে কোনও রিপোর্টই নেই,” বক্তব্য শেওড়াফুলি জিআরপির ওসি অমলেন্দু বিশ্বাসের। “রাত্তির বেলা স্টেশন রোডে এত কিছু হয়ে যাচ্ছে। সাহস করে না জানালে আমরা জানব কেমন করে?”
কিন্তু যাত্রীরা তো বুঝেই উঠতে পারেন না কার কাছে রিপোর্ট লেখাবেন। ‘‘থানায় গেলে বলে জিআরপিতে যাও। আর জিআরপি-তে গেলে প্রশ্ন- “স্টেশনের ঠিক কতটা দূরে ঘটেছিল?” বিরক্ত আক্রান্ত যাত্রী। রিপোর্ট লেখানোর ফলাফল নিয়েও যথেষ্ট সংশয়।
জানাতে হবে কেন? রেগুলার পুলিশ প্যাট্রলিং হয় না কেন? স্টেশন চত্বর কেন অন্ধকার থাকবে? কামরায় কেন মহিলাপুলিশ দেবে না? ছুটে আসে অভিযোগের তির।
চল্লিশোর্ধ তুহিনার অকপট মন্তব্য, “অভিযোগ-টোভিযোগে কিস্যু হবে না। পুলিশ দু’একদিন টহল দেবে। সব চুপ থাকবে। আবার যে কে সেই।”
কর্র্তৃপক্ষ নিরুত্তর।
পুলিশের গাফিলতি? না যাত্রীদের মুখ বুজে থাকা? কে দায়ী এই দুর্ভোগের জন্য? এই বিতর্ক কিন্তু চলতেই থাকবে।
কিন্তু পরিবর্তন?
|