শনিবারের নিবন্ধ ১
আমার সন্তানে যেন ‘দেখি’ দিনে-রাতে
কমাত্র মেয়ে অহনা বরের ঘরকন্না করতে জাপান পাড়ি দিলে অথৈ জলে পড়েছিলেন সুচিত্রা ঘোষ। স্বামী গত হয়েছেন এর কিছু দিন আগে। একলা ফ্ল্যাটের দেওয়ালগুলো তখন যেন গিলতে আসছে তাঁকে। ঠিক এখান থেকেই নতুন করে শুরু হল জীবন।
মেয়ের লিখে-যাওয়া খুঁটিনাটি স্টেপগুলোয় হোঁচট খেয়ে কম্পিউটারে হাতেখড়ি ষাটোর্ধ্বা মায়ের। ইন্টারনেট তথা স্কাইপ এখন তাঁর জীবনটাই পাল্টে দিয়েছে। সুচিত্রা দেখছেন, তাঁর সঙ্গে আড্ডার ফাঁকেই অহনা রান্না করছেন। মেয়ের সংসারের লক্ষ্মীপুজোয় শাঁখ বাজাতেও মা বিনা গতি নেই। কাওয়াসাকির মেয়ে-জামাইয়ের গেরস্থালির কিচিরমিচিরেই সরগরম কসবার ফ্ল্যাট।
নেটের দৌলতে রাশভারী বিনয় দত্তের সঙ্গেও বিলেতপ্রবাসী ছেলে-বউমার দারুণ ভাব। কোনও কালেই ফোনে গুছিয়ে কথা বলতে পারেন না বিনয়বাবু। কিন্তু ফেসবুকে দিব্যি সবার খোঁজখবর রাখছেন। বৃদ্ধের জন্মদিনে কলকাতার রাত বারোটায় একবার ভিডিওচ্যাটে ওয়াইন ‘টোস্ট’ করে তাঁর ছেলেও চমকে দিয়েছিলেন।

নমো যন্ত্র
গ্রাম ছেড়ে কলকাতায় পড়তে যাওয়া অপুর জন্য যন্ত্রণাই সর্বজয়াকে শেষ করে দিয়েছিল। আর আজ হায়দরাবাদ-বেঙ্গালুরু নস্যি! ফ্রাঙ্কফুর্ট-ফড়েপুকুর বা বেহালা-ব্রিসবেনের দূরত্বও অবান্তর। হাজার-হাজার মাইল পেরিয়ে প্রবাসী পুত্রকে ইচ্ছেমতো দেখছেন বা অনর্গল কথা বলছেন মা। সৌজন্যে স্কাইপ, ইয়াহু মেসেঞ্জার, ট্যাঙ্গো, গুগ্ল, ফেসবুক ভিডিওচ্যাট, বিবিএম, ভাইবার, ফেসটাইম, ওয়াট্সঅ্যাপ আরও কত কী! নেট-সংযোগ বা স্মার্টফোন থাকলে নামমাত্র খরচ। বিরহ তুড়ি মেরে উড়িয়ে শুধু যে ‘জোয়ান রক্ত’রাই রাতভর ভিডিওচ্যাটে অনলাইন থাকছেন, কে বলল? কম্পিউটারের ক-অক্ষর গোমাংস বুড়োবুড়িরাও এ দেশে ঝটপট আনকোরাতম যন্ত্র রপ্ত করে হাঁটুর বয়সীদের টেক্কা দিচ্ছেন।
সন্তানের জন্য উৎকণ্ঠা-আশঙ্কা চিরকালই থাকে। তবু বুড়ো বয়সের ঠুকঠুকিয়ে চলার লাঠিটা এখন প্রযুক্তি। টোকিওবাসী প্রান্তিক চক্রবর্তীর মতে, বয়স্কদের জন্য স্মার্টফোন, আইম্যাক, আইপ্যাডই সেরা। ল্যাপটপ ‘অন-অফ’, মাউস সামলানোয় অনেকেই অসুবিধেয় পড়েন। ঘোর মফস্সলে নেটের ঢিকিস-ঢিকিস স্পিড! তবু দূর বিদেশের অবসরমাফিক ‘খোকা’কে দেখতে সাত-সকালে অ্যালার্ম দিয়ে উঠে বুড়োবুড়ি সেজেগুজে অনলাইন। নাতির ধাপে ধাপে বড় হওয়া থেকে ছেলে-বউমার উইক-এন্ড ট্যুরের সচিত্র আপডেটফেসবুক-ইউ টিউবে মজুত। বছর দশেক আগেও ছেলেমেয়েদের বিদেশযাত্রায় যাঁদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিল, তাঁরা অনেকেই নতুন করে বাঁচছেন।

বোনাস, নাতি-নাতনি
বছর পাঁচেকের ঋতিকা ওরফে তুনতুর তুলতুলে হাতের ছোঁয়া বা চুলের মিষ্টি গন্ধ আইপ্যাড বা ল্যাপটপ মারফত পাচার করা যায় না বটে। কিন্তু তার রিনরিনে স্বর, দুলে দুলে নাচ-গানের ভঙ্গি দৃশ্যমান। মেরিল্যান্ডের ওরনিতে নাতি-নাতনির হৃদয় জিততে এখন শীর্ষেন্দুর ভূতের গল্প মুখস্থ করছেন কেষ্টপুরের অমিত বন্দ্যোপাধ্যায়। নাতনি তুনতুও তুখড়। দাদুকে ‘গোলেমালে পিরিত ক’রো না’ শুনিয়ে নতুন শাড়ির ‘প্রমিস’ আদায় করে ছেড়েছে।
লন্ডনে দোলনায় শুয়ে-থাকা একরত্তি নাতনিকে ‘ঘুম-পাড়ানি গান’ শোনাতে কলকাতায় ‘দিয়া’র ডাক পড়ছে। দুই খুদে বিচ্ছুকে আইম্যাকের সামনে দাদু-দিম্মুর জিম্মায় রেখে কাজ সারছেন আমেরিকাপ্রবাসী কন্যা। ছ’বছরের অয়ন আর তিন বছরের ধ্রুবের হুটোপাটি দেখে পলকে
সময় কাবার। নয়াদিল্লিবাসী দাদু অরুণ চক্রবর্তী মেয়ে সম্পৃক্তাকে শোনাচ্ছেন, ‘ধুর, ধুর আর নিউজার্সিতে তোদের কাছে যাব না! আইপ্যাডের সামনে দুই নাতিকে পেলেই চলবে।’

দুধের স্বাদ ঘোলে
কিন্তু স্কাইপ-ফেসবুক যা-ই থাক, তা কখনও রক্তমাংসের মানুষটার বিকল্প হতে পারে বলে মনে করেন না অনেকেই। নেটে নাতি-নাতনিদের প্রায়ই দেখেন সল্টলেকের বেলা ঘোষ। তবু তাঁর অভিমান, “এ তো দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো! আমার হঠাৎ শরীর খারাপ হলে ইন্টারনেট কী করবে!” মুম্বইয়ে ছেলে বা সিঙ্গাপুরে মেয়ে— এই শেষ বয়সে নিজের বাড়ি ছেড়ে কারও কাছেই থাকতে রাজি নন বৃদ্ধা। দীর্ঘদিন আটলান্টাপ্রবাসী রাই নন্দীরও জীবনটা শূন্য মনে হচ্ছে। তাঁর সদ্যসাবালক কন্যা এখন বাড়ি ছেড়ে ‘ডর্মে’ থাকছেন। কলকাতার বন্ধুকে ফেসবুকে রাই লিখছেন, “উফ্, আমাকে ছাড়তেও তাহলে মায়ের এত কষ্ট হয়েছিল!”
কয়েক বছর আগে চলচ্চিত্রায়িত বাণী বসুর গল্প ‘বালিগঞ্জ কোর্ট’ এখনও অনেকের মনে আছে। ছেলে-মেয়ে বিদেশে চাকরি করতে যাওয়া মানেই চির-বিচ্ছেদ! স্বার্থপর পরিযায়ী পাখির মতো মা-বাবাকে ছেড়ে পালাচ্ছে সন্তানেরা। দেশে পড়ে থাকা অভিমানী গুরুজনদের সঙ্গে থমথমে সম্পর্ক আর তাঁদের শরীর নিয়ে নিত্য উৎকণ্ঠা। এই টানাপোড়েনে গল্পের শেষে প্রবাসী পুত্র কেরিয়ার জলাঞ্জলি দিয়ে কলকাতায় ফিরে আসেন।

কান্ট্রিরোড্স টেক মি হোম
কিন্তু ফিরতে চাইলেও কি সবাই ফিরতে পারেন দেশে? প্রশ্ন তুলছেন সেন্ট লুইসপ্রবাসী সুদেষ্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, “মা-বাবাকে ছেড়ে বিদেশে গেলেই তাকে ভিলেন ভাবা ঠিক নয়। অনেকেই দূরে থেকেও দায়িত্বে খামতি রাখেন না।”
দূরে থেকেও সম্পর্ক তাজা রাখার অজস্র নমুনা। যেমন, ২০০৯ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার বঙ্গসম্মেলনে পেশ করা একটি মিষ্টি শর্টফিল্ম। অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরীর ছবিটা, কলকাতার দিদিমা আর আমেরিকার নাতির গল্প। চ্যাটেই দু’জনের বন্ধুত্ব, বোঝাপড়া। সদ্যতরুণ নাতির নতুন ‘ব্যথা’র খবর জানতে পেরেও দিদা দারুণ উৎসাহে তাকে উসকে যাচ্ছেন। অনিরুদ্ধ-ইন্দ্রাণীর মেয়ে প্রেরণাও এখন মায়ামিতে ফিল্ম নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়েছেন। স্কাইপ-ভাইবারের অন্তরঙ্গতা তাঁদের এক সুতোয় বেঁধে রেখেছে। আবার বিদেশে থিতু ঘরছাড়াদের কারও কারও জি-টক স্টেটাসেও মাঝেমধ্যে বেজে ওঠে চেনা-অচেনা ঘরে-ফেরার গান।

পৃথিবীটা না কি ছোট হতে হতে
ছেলেমেয়ে বিদেশে পড়াশোনা বা চাকরি করতে গেলে তবু টেনশনে মনোবিদের চেম্বারে ভিড় করেন অনেক মা-বাবা। অনেক ক্ষেত্রেই এই উৎকণ্ঠাটা যুক্তির ধার ধারে না। ছেলে বা মেয়ে ভাল আছে জেনেও ওরা আমায় ভুলে যাবে না তো, দুশ্চিন্তাটাই বড় হয়ে ওঠে। মনস্তত্ত্ববিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, কে কী ভাবে ভাল থাকবেন সিদ্ধান্তটা তাঁর নিজের। কিন্তু ছেলেমেয়ে কলকাতায় থাকার সময়েও মা-বাবার অঘটন ঘটতে পারে। এ সব পরিস্থিতির জন্য বরং বিকল্প সহায়তা, ডাক্তার-পরিচর্যার ব্যবস্থা রাখা উচিত। অনুত্তমার কথায়, “মা-বাবার চাপে ইচ্ছের বিরুদ্ধে তাঁদের কাছে পড়ে থাকলেও সম্পর্কটা আখেরে ভাল হয় না।”
নিউ আলিপুরের তিমির নন্দীর মতো কেউ কেউ সেটা বোঝেনও। তাঁর মনে হয়, কলকাতায় থাকলেও কি ছেলেকে কাছে পেতাম? বড়জোর কালে-ভদ্রে দেখা, নাতি-নাতনিদের টুকটাক আদর। কিন্তু প্রযুক্তির দৌলতে এই ঘণ্টার পর ঘণ্টা খেলা, হাসি-গল্প হত না। “নেটে দেখলে মনে হয়, ওরা আমার ঘরেই রয়েছে।”

সাস-বহু সমাচার
মেগা সিরিয়ালসুলভ মোচড়েরও অভাব নেই। ওয়েবক্যামের চোখ কখনও হয়ে উঠছে শাশুড়ির শ্যেন দৃষ্টি। দিনভর শ্বশুর-শাশুড়ির নজর-বন্দি বউমার বেডরুমে বারমুডা-টপ পরে ‘রিল্যাক্স’ করা ভণ্ডুল। আবার মাঝরাতে শাশুড়ির ঘুম ভাঙিয়ে ‘আনলিমিটেড কলিং’ ইস্তেমাল করে আমেরিকা থেকে শুক্তোর রেসিপি আদায়। তাও আছে। শিকাগোর ঠান্ডা যে দুর্গাপুরের থেকে ঢের বেশি তা মা ইভাদেবীকে বোঝাতে নাজেহাল মেয়ে ঋতুপর্ণা। শেষটা ল্যাপটপ বাইরে নিয়ে গিয়ে কত জলদি জল জমে বরফ হচ্ছে, দেখালেন।
আমেরিকায় ৪০০ মাইল দূরে ব্রিজ ভাঙলেও সঙ্গে-সঙ্গে ফোনে খোঁজ নিচ্ছে কলকাতা। গড়িয়া-শ্যামবাজারের বেয়াই-বেয়ানরা জড়ো হলেই ‘দুগ্গা-দুগ্গা’ বলে ওয়েবক্যাম-আসর শুরু। ভূগোল বা সময়ের ছক উল্টে টরন্টোয় মেয়ে-জামাইয়ের গৃহপ্রবেশ, প্যারিসে নাতির জন্মদিনসব কিছুই চাক্ষুষ করা যাচ্ছে।
দু’বাড়ির উৎসাহে টেক্সাসে গবেষণারত শিলাদিত্যর সঙ্গে আগরতলার উর্মির ‘প্রথম দেখা’ও তো স্কাইপে। ওয়েবক্যামের গোলমালে শিলাদিত্য অবশ্য হবু বউয়ের মুখটাই বুঝতে পারেননি। আবার জাপানে সুনামির সময়ে কলকাতায় অন-লাইন সুচিত্রাদেবী ‘লাইভ’ দেখলেন মেয়ে-জামাইয়ের অ্যাপার্টমেন্ট দুলছে, জিনিসপত্র লণ্ডভণ্ড। প্রথমে টেনশনের ধাক্কা লাগলেও প্রযুক্তিই দ্রুত তাঁকে আশ্বস্ত করেছিল।

জীবন কিছুটা বেসুর হলেও গান
প্রযুক্তি কিন্তু সম্পর্কের শেষ কথা হতে পারে না বলে মনে করেন, প্রবীণ মৃণাল সেন। ছেলে কুণাল কয়েক দশক ধরে আমেরিকা-প্রবাসী। ফোনে প্রচুর কথা হলেও ভিডিওচ্যাটে কোনও দিন বসা হয়নি। ‘নীল আকাশের নীচে’র পরিচালকের দৃঢ় আস্থা, সম্পর্কের গভীরতায়। “আমরা বুড়োবুড়ি শরীরে-মনে কেমন আছি, কেমন থাকি, এক ফোঁটা গোপন করি না। ছেলে-বউমাও তা-ই করে। মানসিক যোগাযোগটাই হল আসল।”
তবু প্রযুক্তিকেও কি অস্বীকার করা যায়? সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘পূর্ব-পশ্চিম’-এর অতীন, বাবাকে শেষ দেখা দেখতে পায়নি। বাবা মৃত্যুশয্যায় জেনেও আমেরিকার চাকরি-বিমানের টিকিট-ভিসার জটিলতা এড়িয়ে কলকাতায় ফেরা অসম্ভব মেনে নিয়েছিল সে। অতীন বুঝেছিল, দেশভাগের পরে শিকড়চ্যুত তার বাবা প্রতাপের মতোই সে-ও আসলে ছিন্নমূল। এ কালে অজস্র ‘এনআরআই বং’ বা গ্রিনকার্ডধারী বাঙালি কিন্তু নেটের কল্যাণে কলকাতা-শিলিগুড়ি-বর্ধমানের প্রাত্যহিকতায় ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে। সুনীল বলেন, “এখন লিখলে পূর্ব-পশ্চিমের অনেক কিছুই পাল্টে যেত।” বিলেত-আমেরিকায় চটজলদি যাতায়াত, যোগাযোগ সবই ক্রমশ সহজ হয়ে আসছে। স্কাইপে বস্টনবাসী ছেলে-বউমাকে ঘন ঘন দেখছেন সুনীলবাবু ও তাঁর স্ত্রী স্বাতী। ছোট্ট নাতি অয়নের মুখে শিগ্গির গোটা একটা বাংলা বাক্য শোনার অপেক্ষায় দারুণ উত্তেজিত তাঁরা। প্রযুক্তির মহিমায় অপার বিস্ময়ে সুনীলের মনে হয়, এর পরে হয়তো প্রবাসী পুত্রের কথা ভাবলেই তাকে দেখতে, ছুঁতে পারবে মা। সেই দিনটাও আর খুব দূরে নেই।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.