হাঁড়ির খবর
উত্তম মেনু
শ্রেষ্ঠাংশে উত্তমকুমার, সুপ্রিয়াদেবী। আর ভিলেনের নাম ভেটকির কাঁটাচচ্চড়ি।
এই ‘কাঁটাচচ্চড়ি’র জন্যই সে বার নায়ক-নায়িকার ‘বিচ্ছেদ’-এর উপক্রম। মনের মতো কাঁটাচচ্চড়ি না-পেয়ে সুপ্রিয়ার উপরে অভিমানে উত্তম ঘরোয়া পাজামা-পাঞ্জাবি পরেই এক দুপুরে হেঁটে হেঁটে ‘গৃহত্যাগী’ হলেন। নায়কের পিছন-পিছন ‘ঘাট হয়েছে, মাথা খাও’ ভঙ্গিতে আলুথালু নায়িকা। মহানায়কের ‘মবড’ হওয়ার আশঙ্কায় পার্ক স্ট্রিট থানার বড়বাবুকে পর্যন্ত ‘স্পটে’ নামতে হয়েছিল।
সেই ঐতিহাসিক কাঁটাচচ্চড়ি এ বার শহরের রেস্তোরাঁর মেনুতে ঢুকে পড়েছে। শুধু কাঁটাচচ্চড়িই নয়, নিরামিষ থেকে শুরু করে মাছ-মাংস-মুরগি-চিংড়ি-দই-মিষ্টির একটা আস্ত মেনুর অনুষঙ্গেই উত্তমকুমার। উত্তম-ঘরণী সুপ্রিয়ার টিপ্স নিয়েই এই উৎসবের আয়োজনে সিক্স বালিগঞ্জ প্লেস। এটাই প্রথম নয়। ক’বছর আগে ভজহরি মান্নায় ‘তোমাদের দাদা’র প্রিয় পদ খাওয়াতে সুপ্রিয়া ওরফে বাঙালির ‘বেণুদি’ কড়াই-খুন্তি ধরেছিলেন।
বাঙালির পাতে উত্তম-নস্ট্যালজিয়ার আবাহনের হাত ধরেই কিন্তু উঠে আসছে প্রশ্ন, উত্তমকুমারই কি শেষ হিরো যাঁর প্রিয় রান্না নিয়ে এই হইহই রইরই?
শুধু উত্তমই নন, তাঁর সমকালের বলিউড-তারকাদের ভাল-মন্দ স্বাদপ্রীতি ও আন্তরিক আপ্যায়ন নিয়েও নানা কিংবদন্তি। ‘উত্তমকুমার ফুড ফেস্টিভ্যাল’-এর জন্য সুপ্রিয়ার রেসিপি-র অনেকগুলোই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, কিশোরকুমার, ছবি বিশ্বাস, সঞ্জীবকুমার, আরডি, আশা থেকে সঙ্গীতজগতের নক্ষত্র পণ্ডিত রবিশঙ্করের তারিফ পেয়েছে। সদ্য-প্রয়াত রাজেশ খন্নাও ভোজন-বিলাস ও আন্তরিক, সুভদ্র অতিথি আপ্যায়নের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। এর উল্টো পিঠে, আজকের টালিগঞ্জে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের ‘কৃচ্ছ্রসাধন’ নিয়ে সমীহের সুর।
জামাইষষ্ঠী উপলক্ষে পাঁচতারা হোটেলের ফটোশ্যুটে গিয়েছেন প্রসেনজিৎ ও আবির চট্টোপাধ্যায়। চোখের সামনে ছড়ানো অজস্র সুখাদ্য। প্রসেনজিৎ কিন্তু স্রেফ এক কাপ কালো কফি চেয়ে নিলেন। গল্পটা শুনিয়ে আবির বলছিলেন, “বুম্বাদা সত্যিই নমস্য। এই জন্যই ওঁকে এখনও এতটা তরুণ মনে হয়।”
দুটো যুগের জীবনদর্শনের ফারাক মালুম হবে উত্তম ও প্রসেনজিতের মধ্যবর্তী প্রজন্ম রঞ্জিত মল্লিকের কথাতেই। “ভরপেট খেলে অ্যাক্টিং কী করব? তখনও শ্যুট থাকলে আমরা সারা দিন যৎসামান্য খেয়েই কাটাতুম। কিন্তু রাতে একসঙ্গে হইহুল্লোড়, ভালমন্দ চাখার রেওয়াজ ছিল।” তাঁরাও আসন-টাসন করতেন বলে জানাচ্ছেন রঞ্জিত। কিন্তু ডায়েট বা সুঠাম শরীর নিয়ে দুশ্চিন্তা এ যুগের তুলনায় ঢের কম ছিল।
তা হলে আজকের জিম-চর্চিত সিক্স প্যাক অ্যাব্সদের জমানায় স্বাদ-গন্ধ উপভোগের ‘তামসিক’ কর্ম নিয়ে কতটুকু আবেগ অবশিষ্ট বাঙালির মনে? কব্জি ডুবিয়ে ‘নিষিদ্ধ’ সব ভোজ্য নির্ভাবনায় গ্রহণ করেন এমন জলজ্যান্ত ‘রোল-মডেল’ও কি আছে বাঙালির সামনে?
মজাটা হচ্ছে, সে-যুগে উত্তমের প্রিয় চিংড়ির পাতুরি বা মাটন দোপিঁয়াজায় মহিমা আরোপ করা হত। আর এখন দেবের পথ্যি নুনবিহীন মুরগি সেদ্ধ নিয়েও যথেষ্ট আলোচনা হয়। একদা রোভার্স ফাইনালের আগে জুহুর ভেলপুরি খেয়ে মুশকিলে পড়ার কথা কবুল করেছেন ‘ময়দানের উত্তমকুমার’ চুনি গোস্বামী। আর এখন প্রিয় ক্রিকেটারের বিরিয়ানি-আসক্তি নিয়ে মৃদু ঠাট্টা করতেও কসুর করে না বাঙালি।
এ যুগের সিক্সপ্যাক অ্যাব্স-নায়ক টোটা রায়চৌধুরী অবশ্য মনে করেন, উত্তমকুমারদের ভোজ্য-আসক্তি নিয়ে বাজারচলতি ধারণাতেও যথেষ্ট বাড়াবাড়ি। তাঁর কথায়, “ষাটের দশকের গোড়ায় নিজের রোগা শরীরকে হিরোসুলভ করতে উত্তমবাবুও বাড়িতে ব্যায়ামের সরঞ্জাম নিয়ে কসরত করেন শুনেছি।” টালিগঞ্জে ঘনিষ্ঠদের মধ্যে উত্তম বলতেনও, ‘লোকে রাত ১২টা অবধি আমার খানাপিনাটা দেখে, কিন্তু সকালে ময়দানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাঁটার সময়টা চোখে পড়ে না।’
সে যুগে ডায়েটের ধরন নিয়ে ধারণাটা আলাদা ছিল। কিন্তু আউটডোরে পার্শ্বচরিত্ররা ভাল-মন্দ সাঁটালেও নায়ক অসিতবরণ চিকেন স্টু খাবেন, তখনও এটাই দস্তুর ছিল। সৌমিত্রের ব্যায়ামের অভ্যেস, উত্তমের তেড়েফুঁড়ে মর্নিংওয়াকও টালিগঞ্জে সর্বজনবিদিত।
তা হলে খাদ্যরসিক উত্তম না শরীর-সচেতন উত্তম সত্যি কোনটা?
দুটোই। বলছেন সুপ্রিয়া। উত্তমকুমার স্বল্পাহারী, সতর্ক। কত সুখাদ্য দাঁতেই কাটছেন না। আবার তিনিই চিংড়ির পাতুরির সামনে অসহায়। ফ্যাসা-ফ্যাসা চেহারার মুরগির স্টেক মুখে রুচছে না। শিশুর মতো কাঁটাচচ্চড়ি-ডিমের রসার বায়না ধরছেন। সিক্স বালিগঞ্জ উত্তমের এই ‘দুর্বল’ জায়গাগুলোই ধরছে। একেলে রুচির কথা ভেবে কিছু হাল্কা রদবদল। ফ্লেভার অটুট রেখেও কাঁটাচচ্চড়িতে যেমন খানিকটা মাছের ফিলে মিশছে।
আবির-টোটারা হাসছেন, “আমাদেরও তো আমিনিয়ার বিরিয়ানি, চাংওয়ার চিলি পর্কের জন্য মাঝেমধ্যে প্রাণ আনচান করে।” টোটার নিদান, “ছ’দিন কষ্ট করলে, টুকটাক মুখ চালানো, বেশি রাতে না-খাওয়ার মতো নিয়ম মানলে হপ্তায় এক দিন হিরোরাও কব্জি ডুবোতেই পারেন!”
উত্তমের ঘনিষ্ঠেরা বলেন, মহানায়কও কষ্ট করেই মাঝেমধ্যে মুখ বদলাতেন। ডায়েটে গ্রহণ-বর্জন নিয়ে টানাপোড়েনের যুগেও উত্তমের পছন্দের রান্না তাই বাঙালির কাছে উত্তম-সংস্কৃতির স্বাক্ষর।

ছবি: শুভেন্দু চাকী




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.