ব্যাগ গুছিয়ে...
ডাকছে যোগপ্রপাত
ন্য রুট খুঁজছেন? চলে আসতে পারেন যোগপ্রপাতের দেশে। সোজা চলে গেলাম বেঙ্গালুরু। শরৎ-নীল আকাশে মাঝেমাঝেই বৃষ্টির রিমঝিম। রাস্তা ধুয়ে আরও সাফ। শহরের সীমান্তে ভিড় করে আছে আকাশছোঁয়া ইমারত। ঝাঁ চকচকে শহর দেখতে দেখতে রুফটপ রেস্তোরাঁয় রাতের ডিনার। শেষে বেঙ্গালুরু স্টেশনে যখন পৌঁছলাম তখন ঘড়িতে রাত সাড়ে ন’টা। নির্দিষ্ট সময়ে বৃষ্টিতে কাকভেজা সিমোগা এক্সপ্রেস হাজির। তার পরে নিকষ কালো অন্ধকার ভেদ করে ছুটে চলা। চলেছি সিমোগ পাহাড়ের কোলে যোগপ্রপাতের দেশে।
কাকভোরে ট্রেন থামল সিমোগায়। পাহাড়ের কোলে কেউ যেন স্টেশনটা বসিয়ে দিয়ে গেছে। পুব আকাশ ফর্সা হতে হতে লাল-রঙা সূর্যটা আরও স্পষ্ট হল। যত দূর চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। দূরে ব্রোঞ্জরঙা পশ্চিমঘাট পর্বতের হাতছানি। পাহাড়ের বুক চিরে চলে গিয়েছে মিশকালো পিচ-পথ। যত এগোচ্ছি সবুজ আরও গাঢ় হচ্ছে। পাহাড়কে ঘিরে ধরেছে জঙ্গল। মাঝেমধ্যে আকাশ ঢাকা পড়েছে সবুজের চাদরে।
গোটা রাস্তায় অসহ্য একঘেয়ে ঝিঁঝির ডাক। তারই মাঝে ডানা ঝাপটে উড়ে যাচ্ছে সবুজ টিয়ার দল। বুনো সোঁদা গন্ধে ম ম করছে চারপাশ। মাঝপথে গাড়ি থামল। পাহাড়ের এক কোণে এক সুন্দর ঘরোয়া রেস্তোরাঁ। কফি আর মেদু বড়ার উপাদেয় কন্নড় ব্রেকফাস্ট। তার পরে আবার পাহাড়ের আঁকাবাঁকা জংলা পথে এগিয়ে চলা। জঙ্গল শেষ হতেই টের পাওয়া গেল বৃষ্টির তেজ। সামনের পথটা সাদা ঝাপসা। গাড়ি গড়াতে গড়াতে থামল, পাহাড়ের খাঁজে। গাড়ির ছাদে বৃষ্টির কবিতা শুনতে শুনতে, বৃষ্টির তেজ কমে এল। ড্রাইভার জানাল, এই পাহাড় পেরোলেই পৌঁছে যাব। দেখতে দেখতে বদলে গেল দৃশ্যপট। ও পাহাড়ে বৃষ্টি। এ পাহাড়ে রোদ্দুর। খটখটে শুকনো। প্রকৃতির এই রূপ বদলের প্রতিটি রূপ-রস বন্দি হচ্ছে ডিজিটাল ক্যামেরার মেমরি চিপে।
আদিগন্ত পাহাড় দু’ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে। বিশাল সেতুর এক কোণে গাড়ি দাঁড়াতেই কানে এল বিশাল জলরাশির ধেয়ে আসার শব্দ। পাহাড়ের বুক বেয়ে ধেয়ে আসছে একটা নদী, শরাবতী। দুরন্ত উচ্ছ্বাস, দুর্দান্ত উদ্দাম নদীর চলনে। বিশালাকৃতির কিছু পাথর বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু এ কী? নদী হঠাৎ উধাও কেন? ব্রিজের পাশের লালমাটির রাস্তা ধরে চললাম নদীর খোঁজে। পথের দু’ধারে জংলা ফুলের বাহার। রাস্তা এসে মিশেছে একটা সুন্দর বাংলোর সামনে। হাতখানেক দূরে সুন্দর ভিউ পয়েন্টে দাঁড়াতেই নদী হারানোর রহস্যের সমাধান হল। শরাবতী নদী পা পিছলে ঝরে পড়ছে ঝর্না হয়ে। ১২০০ ফুট নীচে ঝাঁপিয়ে পড়ছে তীব্র ধারায়, কিন্তু চার ভাগে ভাগ হয়ে। রাজা, রানি, রকেট এবং রোয়িয়ার। এই চারধারা একত্র হয়ে ‘যোগ ফলস’ নাম নিয়েছে। তাদের ঝরে পড়ার ছন্দে মিশেছে রোদের গুঁড়ো। ফুটে ওঠে সাতরঙা রামধনু।
কপালগুনে বাংলোর বুকিং পাওয়া গেল। শান্ত রোয়িয়ারের হৃদয়ে রকেটের উত্তাল জলধারায় উচ্ছ্বাস দেখতে দেখতে সিমোগ পাহাড়ের অল্পচেনা ঝর্নাতলায় দিন ফুরিয়ে আসে। ঘরেফেরা পাখিদের কলতান। আকাশের পশ্চিমকোণে কারা যেন রং ছিটিয়ে মুহূর্তে রঙিন করে গেল। দিগন্ত জুড়ে রঙের রায়ট। সন্ধে নামতেই নিস্তব্ধ প্রকৃতির বুকে জেগে আছে পেতল-রঙা চাঁদ আর যোগপ্রপাতের অবিরাম ঝরে পড়া। সেই ধ্বনি সিমোগ পাহাড়ের আনাচেকানাচে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসে বারে বার। জাফরি-কাটা জ্যোৎস্না মায়াবী হয় রাতে। কিন্তু জ্যোৎস্না রাতে বনে যাবার ক্ষেত্রে কঠোর নিষেধাজ্ঞা। বড় জোর বাংলোর বারান্দা পর্যন্ত।
পরদিন সকালে আকাশের মুখ ভার। চার ধারা চার ভিউ পয়েন্ট। যে দিকেই দেখা যাক না কেন সবেতেই সুন্দরী যোগ। মূল ভিউপয়েন্টে যেতেই বুঝলাম। দূরে সিমোগ পাহাড়। শরাবতী ও যোগের সৌন্দর্য। সব মিলিয়ে এক অপার্থিব ঈশ্বরের বাগান। ডান দিকে প্যাঁচানো সিঁড়ি নেমে গিয়েছে। প্রায় ১২০০ ফুট নীচে। প্রতিটি ধাপেই জলগুঁড়োয় ভেজে শরীর। এক সময় ভিজে চুপচুপে। বিকট শব্দে আছড়ে পড়ছে গ্যালন গ্যালন জল। ধবধবে সাদা, দুধের মতো। পাথরের বুকে গভীর খাতে বয়ে চলেছে দামাল ঝর্নাধারা। সেই গভীর খাত থেকে উঠে আসছে অজস্র জলকণা। তবে সেই মায়াময় ঈশ্বরের বাগান থেকে ফিরে আসতে হল। কিন্তু মনের মধ্যে সিমোগ পাহাড়। শরাবতীর উচ্ছ্বাস আর যোগপ্রপাতের মুগ্ধতার অনুরণন।

কী ভাবে যাবেন

হাওড়া থেকে ট্রেন অথবা বিমানে বেঙ্গালুরু।
গাড়িতে অথবা ট্রেনে সিমোগা হয়ে চলে আসা যায় যোগ ফল্স
কোথায় থাকবেন
একটি সরকারি বাংলো ও বেসরকারি হোটেল রয়েছে। আগেভাগে বুকিং করতে হবে।
প্রয়োজনীয় তথ্য
বর্ষাতি, ছাতা, টর্চ, মশার ক্রিম রাখা দরকার। মূল ভিউ পয়েন্টে গিয়ে
যোগপ্রপাতের নীচে নামার ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্ক হতে হবে। না হলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.