ওষুধের চূড়ান্ত আকাল চলছে আরামবাগ মহকুমা হাসপাতালে। রোগীদের প্রায় সব ধরনের ওষুধই বাইরে থেকে কিনতে হচ্ছে। এমনকী, ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জও মিলছে না হাসপাতালে। হাসপাতালের সুপার নির্মাল্য রায়ের অভিযোগ, জেলা থেকে ওষুধের সরবরাহ নেই। ওষুধ কেনার জন্য কিছু দিন আগে ২০ লক্ষ টাকা পাওয়া গেলেও নিয়ম-নীতির ফাঁসে তা-ও কেনা যাচ্ছে না। চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনার ১ লক্ষ টাকাও পড়ে আছে বলে জানিয়েছেন সুপার।
আরামবাগ মহকুমা হাসপাতালে শয্যাসংখ্যা খাতায়-কলমে ২৫০। কিন্তু প্রতি দিন রোগী থাকেন গড়ে প্রায় ৪০০। হুগলি ছাড়াও সংলগ্ন জেলা বর্ধমান, বাঁকুড়া, হাওড়া ও দুই মেদিনীপুর থেকে রোগী আসেন এই হাসপাতালে। সঙ্কট শুধু ওষুধেই নয়, প্রয়োজনীয় চিকিৎসক, কর্মীও অপ্রতুল মহকুমা হাসপাতালে। বিভিন্ন বিভাগে চিকিৎসক থাকার কথা ৩৬ জনের। কিন্তু আছেন মাত্র ২৪ জন। রেডিওলজিস্ট নেই। প্যাথলজি টেকনিসিয়ান ৪ জনের বদলে আছেন দু’জন। যে কারণে রক্ত পরীক্ষার রিপোর্টে পেতেও সপ্তাহ ঘুরে যাচ্ছে। অনেকে বাধ্য হয়ে বাইরে থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিয়ে নিচ্ছেন। ইসিজি টেকনিসিয়ান দু’জনের পরিবর্তে আছেন এক জন। এই পরিস্থিতিতে দুপুর ২টোর পরে ইসিজি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। বাইরে থেকে ইসিজি করাতে বাধ্য হচ্ছেন রোগী। সর্বোপরি, জিডিএ (জেনারেল ডিউটি অ্যাসিস্ট্যান্ট) ৮০টি পদের মধ্যে আছেন মাত্র ৩৫ জন। কেউ অবসর নিলে বা বদলি হলে সেই পদ পূরণ করা যাচ্ছে না। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, সার্বিক সমস্যা ক্রমে ঘণীভূত হচ্ছে। হাসপাতালে কার্যত তালা মারার উপক্রম হয়েছে। জেলা ও রাজ্য-স্তরে একাধিক বার সমস্যার কথা জানিয়েও সুরাহা হয়নি। |
স্বাস্থ্য দফতরের সঠিক চিন্তা-ভাবনার অভাবেও মহকুমা হাসপাতালে এই হাল বলে অভিযোগ।
মহকুমা হাসপাতালে রেডিওলজিস্ট নেই, অথচ, এই মহকুমারই গোঘাটের নকুন্ডা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এক জন রেডিওলজিস্টকে ‘বসিয়ে রাখা’ হয়েছে। সেখানে এক্স-রে সংক্রান্ত কোনও পরিষেবা দেওয়ার প্রশ্নই নেই। এমনই অবস্থা ল্যাবরেটরি টেকনিসিয়ানের ক্ষেত্রে। মহকুমা হাসপাতালে এই পদে মাত্র দু’জন থাকলেও খানাকুল গ্রামীণ হাসপাতালে আছেন ৩ জন। তারকেশ্বর গ্রামীণ হাসপাতালেও আছেন ৩ জন। প্রয়োজন ছাড়াই খানাকুল গ্রামীণ হাসপাতালে এক জন ইসিজি টেকনিসিয়ান আছেন। অথচ, সব পরিস্থিতিতেই এ সব হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলির তুলনায় মহকুমা হাসপাতালে রোগীর চাপ অনেক বেশি। এই সমস্ত তথ্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েও অবশ্য কোনও লাভ হয়নি বলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি।
মহকুমা হাসপাতালটির দূরবস্থার আরও নজির আছে। আলট্রাসনোগ্রফি যন্ত্র মাস ছ’য়েক ধরে বিকল। দুঃস্থ রোগীদের প্রায় হাজার টাকা খরচ করে বাইরে থেকে এই পরিষেবা নিতে হয়। রোগী কল্যাণ সমিতির তহবিল শূন্যে এসে ঠেকেছে। জরুরি ভিত্তিতে কেনা-কাটা বন্ধ। প্রতি বছর মার্চ মাসে রোগীকল্যাণ সমিতি ১ লক্ষ টাকা করে পেয়ে থাকে। এ বছর সেই টাকা মেলেনি।
মহকুমা হাসপাতালে ময়না-তদন্তের জন্য কোনও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই। যে কোনও বিভাগের চিকিৎসকেরাই এই দায়িত্ব নিয়ে থাকেন। প্রতি দিন গড়ে তিন-চারটি করে ময়না-তদন্ত হয়। প্রায় প্রতি দিনই ওয়ার্ডে জলের সরবরাহ বিঘ্নিত হয়। বিশাল হাসপাতালে বছর তিরিশ আগে একটি পাম্প বসানো হয়েছিল। কিন্তু তা দু’দিন অন্তর খারাপ হয়ে পড়ে থাকে। পুরসভাকে ৬-৭টি ট্যাঙ্ক পাঠিয়ে জল সরবরাহ করতে হয়।
জনস্বাস্থ্য কারিগরী দফতরের অধীন পাম্পটি সংস্কার হচ্ছে না। বিকল্প হিসাবে মাস কয়েক আগে নতুন যে পাম্প বসানো হয়েছে, তা থেকেও জল উঠছে না বলে অভিযোগ। যদিও জনস্বাস্থ্য কারিগরী দফতর থেকে বলা হয়েছে, খুব শীঘ্রই কাজ হবে।
পরিস্থিতি যেমন জটিল আকার নিয়েছে, তাতে সমস্যাগুলির আশু সমাধান আদৌ সম্ভব কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে বিভিন্ন মহলে। কিন্তু ন্যূনতম পরিষেবা হিসাবে ওষুধপত্রের জোগান নেই কেন? ২০ লক্ষ টাকাও বা খরচ করা যাচ্ছে না কেন?
হাসপাতাল সূত্রের খবর, অনলাইনে ওষুধ কিনতে হয়। ওয়ে বিল জমা দিতে হয়। এ বার যে সব ওষুধ কেনার তালিকা দেওয়া হয়েছে, সেগুলির নির্মাতা সংস্থাগুলি বেশির ভাগই ভিন রাজ্যের। কিন্তু ওষুধ কেনার এই প্রক্রিয়াটাই ঠিকঠাক গড়ে ওঠেনি বলে অভিযোগ। বর্তমানে এই হাসপাতালে প্রতিষেধক নেই বললেই চলে। ১০০০টি সাপে কাটার প্রতিষেধক (এভিএস) চাওয়া হয়েছিল। জেলা থেকে মিলেছে ১৫টি। ডায়েরিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ওষুধগুলি নেই। নির্মাল্যবাবুর অভিযোগ, ওষুধ চেয়ে প্রায় প্রতি দিনই জেলায় প্রতিনিধি পাঠাচ্ছি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে চাহিদাপত্রই ফিরে আসছে। যদি বা কখনও মিলছে, তা-ও দু’হাজার চাইলে ১৫টা-১৭টা পাওয়া যাচ্ছে।” সুপারের অভিযোগ, এই পরিস্থিতি রোগী ও তাঁর পরিবারের লোকজনকে বোঝানো শক্ত। ফলে, মাঝে-মধ্যেই হেনস্থা হতে হচ্ছে চিকিৎসক, চিকিৎসা কর্মীদের। ‘ভীত-সন্ত্রস্ত্র’ চিকিৎসকেরা অনেকে ছুটি নিতে চাইছেন।
হুগলির মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক তনিমা মণ্ডলকে একাধিক বার ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও প্রতি বারই তিনি ‘ব্যস্ত আছি’ বলে ফোন রেখে দিয়েছেন। আর রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের মুখপাত্র হিসাবে মুখ্যসচিব গত ২১ ফেব্রুয়ারি নির্দেশিকা জারি করে যে টেকনিক্যাল অফিসারের সঙ্গে যোগাযোগের নম্বর দিয়েছিলেন, সেই অসিত বিশ্বাসের নম্বর দু’এক বার রিং হয়েই কেটে যাচ্ছে।
সব মিলিয়ে পরিস্থিতি যে তিমিরে সেই তিমিরেই। |