পাঁচ বছর বয়সেই সুদীপের গন্ধ পাওয়ার ক্ষমতা কমে গিয়েছে। সঙ্গে রয়েছে নাকে জ্বালা ও অন্যান্য উপসর্গ।
মেলা থেকে কেনা লাট্টু নিয়ে খেলতে খেলতেই ঘটেছে বিপত্তি। আলো জ্বলা ওই খেলনার ভিতর থেকে বেরিয়ে আসা খুদে ব্যাটারি খেলাচ্ছলে নিজের নাকে ঢুকিয়ে ফেলেছে শিশুটি। ক্ষারযুক্ত সেই ব্যাটারি বার করা হলেও রাসায়নিক বিষক্রিয়ার ফলে যে ক্ষতি ইতিমধ্যেই হয়ে গিয়েছে, তার চিকিৎসা করাতে প্রায়ই হাসপাতালে হাজির হতে হয় সুদীপকে।
আর এ ভাবেই শিশুদের ঘিরে সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকার খেলনা-শিল্পের যে বৃত্ত তৈরি হয়েছে, তাতে শিশুরাই অভিমন্যু হয়ে যাচ্ছে। শিশু মনের রসদ হিসেবে যে খেলনা হাতে তুলে দেওয়া হয়, সেটিই তাদের বিপদ ডেকে আনতে পারে। কারণ খেলনার গুণমান বজায় রাখার জন্য নেই কোনও সরকারি বিধিনিষেধ। ব্যুরো অফ ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ড (বি আই এস) গত বছরের শেষে একটি খসড়া নীতি তৈরি করে। বছর ঘুরতে চললেও সেই নীতি এখনও চালু হয়নি।
আইনি বাধ্যবাধকতা না থাকায় ন্যূনতম মান বজায় রাখার দায় নেই খেলনা নির্মাতাদের। ফলে কচিকাঁচাদের নিত্য বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে খেলনায় ব্যবহৃত রং, ধাতু ইত্যাদি। ফুটপাথ, পাড়ার দোকান, এমনকী শপিং মল থেকে কেনা আপাত নিরীহ খেলনাই ডেকে আনছে বিপর্যয়। সাধারণত ব্যাটারি-যুক্ত খেলনা ছোটদের প্রিয় হয়। এ ধরনের খেলনায় আলো জ্বলে, আওয়াজ হয়। নড়েচড়ে ঘুরে বেড়ায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় ভিতরের ব্যাটারি খুব সহজে বেরিয়ে আসছে। সেটা নিয়েও খেলায় মজে খুদেরা। |
তাই সুদীপের ঘটনা বিচ্ছিন্ন নয় বলে দাবি চিকিৎসকদের। ব্যাটারি বার করার পরেই থেমে থাকে না রাসায়নিক বিষক্রিয়ার প্রভাব। ইএনটি চিকিৎসক চিরজিৎ দত্ত জানান, ক্ষারযুক্ত ব্যাটারি দ্রুত গলতে শুরু করে। নাকের জল বা কানের খোলের সঙ্গে মিশে তা ক্রমশ ভিতরে ছড়িয়ে পড়ে। দ্রুত নষ্ট করতে থাকে বিভিন্ন কোষ। সেই ক্ষতি ওষুধেও সারে না। নাকের আকার বদলে যাওয়া থেকে নিশ্বাস নিতে কষ্ট, গন্ধ পাওয়ার ক্ষমতা হ্রাসের মতো নানা সমস্যার আশঙ্কা থাকে। কানের পর্দা ফুটো হলে শ্রবণশক্তিও হারাতে পারে শিশু।
বি আই এস সূত্রের খবর, খেলনার গুণমান সংক্রান্ত যে নিয়ম এখন রয়েছে, তা বাধ্যতামূলক নয়। দেশি বা বিদেশি খেলনা নির্মাতাদের এ দেশে ব্যবসা করতে হলে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বি আই এস-এ নথিভুক্ত হতে হবে। কোনও আইনি বাধ্যবাধকতা না থাকায় এই নিয়ম যে আপাতত লোক দেখানো, তা জানে বি আই এস। প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো ছাড়া নথিভুক্তি বাধ্যতামূলক করা সম্ভব নয় বলেই মনে করছেন সংস্থার কর্তারা। প্রস্তাবিত নীতিতে অবশ্য ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আদলে খেলনায় ব্যবহৃত ধাতু, যন্ত্রাংশের পাশাপাশি বিভিন্ন রাসায়নিক ব্যবহারের পরিমাণেও বিধিনিষেধ আরোপ করার ব্যবস্থা থাকছে।
গুণমান বজায় রাখার বিষয়টি বদলে দিচ্ছে বাজারের গতিবিধিও।
একটি খেলনা তৈরির সংস্থার অন্যতম কর্তা অভিনীত গুপ্তের দাবি, আন্তর্জাতিক স্তরের মান বজায় রাখতে খেলনার উপকরণ নিয়ে আপস করা সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট দামের নীচে খেলনা বিক্রি করা যায় না। ফুটপাথ ছেয়ে যাওয়া সস্তা খেলনার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামতে পারবে না নামী ব্র্যান্ড। তিনি বলেন, “ই এন সেভেন্টি ওয়ান-এর মতো ইউরোপীয় ইউনিয়নের তৈরি মানদণ্ড এ দেশে নেই। বিদেশ থেকে আমরা যে খেলনা আমদানি করি, তা এই মানদণ্ড মেনেই হয়। রফতানির ক্ষেত্রেও একই নিয়ম।” দামের প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য, নির্দিষ্ট মাপকাঠি না থাকায় বাবা-মাকেই সচেতন হতে হবে। তুলনামূলক কম দামে খেলনা কিনে বিপদ ডেকে আনার প্রবণতা আটকানোর দায় তাঁদেরও রয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
বাজার ভর্তি সস্তার খেলনা শুধুই চিনে তৈরি খেলনা নয়। যদিও বিশ্ব জুড়ে খেলনার বাজারের ৭০ শতাংশ চিনের দখলে। কম দামি চিনে খেলনার সঙ্গে পাল্লা দিতে মানের সঙ্গে আপস করছে স্থানীয় সংস্থারাও। প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকতে দাম কমাতে মান নিয়ে বিশেষ মাথা ব্যথা করছে না অধিকাংশ সংস্থাই। এ কথা স্বীকার করে নিয়েছে ‘টয় অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়া’। তাই সরকারি বিধিনিষেধ তৈরি হওয়ার পক্ষেই রয়েছে তারা।
বণিকসভা ‘অ্যাসোচ্যাম’-এর হিসেব অনুযায়ী, ২০১৫ সালে এ দেশে খেলনা-শিল্পের পরিমাণ দাঁড়াবে ১৩ হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে এই ব্যবসার পরিমাণ ৭৫০০ কোটি টাকা। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিচ্ছে এই শিল্প।
সব মিলিয়ে খেলনা প্রস্তুতকারক সংস্থার সংখ্যা ৮০০-র কাছাকাছি। এর মধ্যে ৬০ শতাংশ রয়েছে দিল্লি ও লাগোয়া অঞ্চলে। ৩০ শতাংশ মুম্বই-এ। বাকি ১০% দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। |