ডেঙ্গির প্রকোপ হোক বা মাওবাদীদের দাপট, দুই ক্ষেত্রেই প্রতিরোধের দর্শনটা একই রকম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের কাছে। ডেঙ্গির ক্ষেত্রে যেমন মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ, আপাত দৃষ্টিতে জীবাণুর প্রকোপ কমেছে বলে মনে হলেও প্রতিরোধের কাজে ভাটা দেওয়া চলবে না। একই ভাবে মাওবাদীদের কার্যকলাপে ভাটা পড়েছে বলে মনে হলেও তাদের বিরুদ্ধে অভিযানের তীব্রতা বাড়াতে পাঁচমুখী নীতি নিয়েছে রাজ্য প্রশাসন।
জঙ্গলমহলে মাওবাদীদের কোণঠাসা করার পরে এ বার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশাসনের লক্ষ্য হল: রাজ্যে মাওবাদীদের সব স্কোয়াড-নেতাকে যত শীঘ্র সম্ভব গ্রেফতার বা আত্মসমর্পণে বাধ্য করা। জঙ্গলমহলের প্রতিটি কোণে ফের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া পুরো দমে চালু করা। এ ছাড়া, শহরের সঙ্গে জঙ্গলমহলের যোগসূত্র রক্ষার কাজটি করছে যে-সব মাওবাদী নেতা, তাদেরও গ্রেফতার করা।
মাওবাদীদের কলকাতা সিটি কমিটির সম্পাদক ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র অভিষেক মুখোপাধ্যায় তথা অরণ্য ও তার দুই সঙ্গীকে মঙ্গলবার রাতে টালা থানা এলাকা থেকে গ্রেফতার করা এই প্রক্রিয়ারই অঙ্গ বলে রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতর সূত্রের খবর। পুলিশের দাবি, অভিষেক বিবাহিত এবং তাঁর স্ত্রী দেবলীনা চক্রবর্তীও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রী। এ বছর এপ্রিল মাসে নোনাডাঙা উচ্ছেদ কাণ্ডে মাওবাদী সন্দেহে ধৃত দেবলীনা এখন জেলে। |
চন্দননগরের বাসিন্দা অভিষেক প্রথম প্রচারের আলোয় আসেন ২০০৬-এর ডিসেম্বরে। সে বার সিঙ্গুর নিয়ে অসন্তোষের সময়ে আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু রোডের একটি মোটর গাড়ির শোরুম ভাঙচুর করে গ্রেফতার হন তিনি। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ২০০৭-এ গা ঢাকা দেন অভিষেক। মাঝের এই সময়ে তিনি জঙ্গলমহলে কিষেণজির তত্ত্বাবধানে অস্ত্র প্রশিক্ষণও নিয়েছেন বলে গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন। কলকাতা পুলিশের স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ) অভিষেকের সঙ্গে সুনীল মণ্ডল ওরফে নীল এবং সুভাষ রায় ওরফে সমীরকে গ্রেফতার করেছে। এসটিএফের দাবি, কলকাতা সিটি কমিটির অন্যতম সদস্য এই সুনীল। ধৃতদের কাছ থেকে ৩টি আগ্নেয়াস্ত্র, ৬ রাউন্ড গুলি ও মাওবাদীদের প্রচুর নথিপত্র পাওয়া গিয়েছে। বুধবার আদালত তিন জনকেই সাত দিনের জন্য পুলিশি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছে।
রাজ্য সরকারের মতে মাওবাদী মোকাবিলার ক্ষেত্রে কিছু সাফল্য এলেও কাজ সম্পূর্ণ হয়নি। আকাশ, বিকাশ, রঞ্জিৎ পাল, মদন, জয়ন্ত, শ্যামল, ভীম, সীতার মতো স্কোয়াড-নেতাদের এখনও ধরা যায়নি। তা ছাড়া, নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার ১৬ মাস পরেও জঙ্গলমহলের ৩০টিরও বেশি পঞ্চায়েত এলাকায় রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শুরু করা যায়নি। এখনও পুরুলিয়া, বাঁকুড়া ও পশ্চিম মেদিনীপুরের অন্তত ৫০টি আদিবাসী-অধ্যুষিত গ্রামে মাওবাদীদের সশস্ত্র স্কোয়াডের আনাগোনা আছে। সব চেয়ে বড় কথা, ঝাড়গ্রাম মহকুমার বেশ কিছু এলাকায় পুলিশি সন্ত্রাস-বিরোধী জনসাধারণের কমিটির এক সময়কার কিছু নেতা ও প্রথম সারির কর্মী এখন আপাত দৃষ্টিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়লেও তলে তলে তারা আকাশ, বিকাশ ও মদন মাহাতোর মতো মাওবাদী স্কোয়াড-নেতার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন।
সরকারের কাছে এমন তথ্যও রয়েছে যে, রাজ্যে একটি ‘বন্দিমুক্তি সংহতি পরিবার মঞ্চ’ গঠনের তৎপরতা শুরু হয়েছে। আপাতত গড়া হয়েছে তার ‘প্রস্তুতি মঞ্চ’। এই মঞ্চই রাজনৈতিক বন্দিদের ক্ষুব্ধ পরিবারগুলিকে একজোট করবে যাতে বন্দিমুক্তির জন্য সরকারের উপরে চাপ সৃষ্টি করা যায়।
এই পরিপ্রেক্ষিতেই মাওবাদীদের বিরুদ্ধে নতুন করে আঘাত হানতে পাঁচটি কৌশল নিয়েছে রাজ্য।
এক, সুনির্দিষ্ট গোয়েন্দা-তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে স্কোয়াড-নেতাদের প্রত্যেককে হয় গ্রেফতার করা, না-হলে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে অস্ত্র-সহ তাদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করা। ইতিমধ্যেই ধৃত ও আত্মসমর্পণকারী মাওবাদীদের কয়েক জনকে এবং পলাতক মাওবাদী স্কোয়াড-নেতাদের আত্মীয়দের এই কাজে লাগানো হয়েছে।
দুই, পশ্চিম মেদিনীপুরের বেলপাহাড়ি, কাঁকো, বিনপুর ও জামবনি, বাঁকুড়ার সারেঙ্গা এবং পুরুলিয়ার বান্দোয়ান ও বলরামপুরে যৌথ বাহিনীর টহলদারি আরও বাড়ানো এবং একই সঙ্গে সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি করা। যাতে তাঁদের কেউ কেউ ‘সোর্স’ হিসেবে পরবর্তী কালে নির্দিষ্ট খবর দিতে পারে।
তিন, জঙ্গলমহলের প্রতিটি জায়গায় রাজনৈতিক প্রক্রিয়া নতুন করে চালু করা। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যেপাধ্যায় এ পর্যন্ত পাঁচ বার জঙ্গলমহল সফর করেছেন। বিশেষ করে বেলপাহাড়ি ও নয়াগ্রামের মতো ঝুঁকিপূর্ণ ও দুর্গম জায়গায় তাঁর সড়কপথে যাত্রা সাধারণ মানুষকে অনেকটাই আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছে বলে গোয়েন্দাদের দাবি। রাজ্য গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত ডিরেক্টর জেনারেল বাণীব্রত বসু বলেন, “রাজনৈতিক প্রক্রিয়া সব জায়গায় ফের চালু হলে সাধারণ মানুষ অনেকটাই আত্মবিশ্বাস ফিরে পাবেন এবং সে ক্ষেত্রে তাঁরা নিজেরাই স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে মাওবাদীদের প্রতিরোধ করতে পারবেন।”
চার, জঙ্গলমহলের পিছিয়ে পড়া জায়গায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পানীয় জল, সেচ ও গ্রাম সড়কের কাজে গতি আনা। প্রশাসনের বক্তব্য, বর্তমানে এই সব কাজ বিশেষ অগ্রাধিকার দিয়ে করা হচ্ছে। রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়নমন্ত্রী সুকুমার হাঁসদার দাবি, “এখনও পর্যন্ত আমার দফতর ৮০ কোটি টাকার উপরে প্রকল্পের কাজ হাতে নিয়েছে।”
পাঁচ, মাওবাদীদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সমালোচনা করে লেখা ওড়িশায় পার্টির প্রাক্তন রাজ্য সম্পাদক সব্যসাচী পাণ্ডার লেখা চিঠির অংশবিশেষ বাংলা ও সাঁওতালি ভাষায় অনুবাদ করে লিফলেট ও পোস্টার তৈরি এবং গোটা জঙ্গলমহলে তা ছড়িয়ে দেওয়া। সিপিএম-ও এই পরিকল্পনাকে স্বাগত জানিয়েছে। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য তথা বাঁকুড়ার জেলা সম্পাদক অমিয় পাত্র বলেন, “সব্যসাচী পাণ্ডা দলে থাকাকালীনই নেতৃত্বের সমালোচনা করেছেন। সেই বক্তব্য ঠিক মতো প্রচার করলে গোটা জঙ্গলমহলেই এর ইতিবাচক প্রভাব পড়তে বাধ্য।”
|