ডানকুনির পর উলুবেড়িয়া। চলতি মাসেই বন্ধ হয়ে গেল লাভে চলা আরও একটি কারখানা।
শ্রমিক অসন্তোষের অভিযোগ তুলে গত ৩ সেপ্টেম্বর ডানকুনির ভগবতী বিস্কুট কারখানায় উৎপাদন বন্ধ করে দেন মালিক। এর দশ দিনের মধ্যে বুধবার কারখানা বন্ধ করে দিলেন উলুবেড়িয়ায় করোনেশন ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের মালিক। কারণ, মঙ্গলবার বিকেল থেকে কারখানার কর্তৃপক্ষকে টানা ২৩ ঘণ্টা ঘেরাও করে রেখেছিলেন বিক্ষুব্ধ শ্রমিকেরা।
উলুবেড়িয়ার ওই কারখানার অন্যতম মালিক শুভব্রত (স্টিভ) সাহা এখন বিদেশে। তাঁর প্রতিক্রিয়া, “৫০০ জন শ্রমিকের একটি কারখানা ২৫ জন লোক বন্ধ করে দিল! ৭০ জনকে ২৩ ঘণ্টা ধরে আটকে রাখল! প্রশাসন তাঁদের মুক্ত করতে পারল না! তা হলে আমরা কী করে এই ব্যবস্থার প্রতি আস্থা রাখব? এই প্রশাসন তো আমাদের শিল্প ও লগ্নির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবে না।”
|
শুভব্রত সাহা |
কারখানার মালিক প্রশাসনকে দুষলেও রাজ্য সরকার কিন্তু পাল্টা তাঁকেই দোষ দিচ্ছে। রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের প্রশ্ন, কারখানা বন্ধের আগে কর্তৃপক্ষ কেন প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করলেন না। তাঁর কথায়, “এ ভাবে কারখানা বন্ধ করা যায় না। শ্রমিকদের বক্তব্য শুনতে হবে। আমাদের সঙ্গেও আলোচনা করা উচিত ছিল।” কারখানা কর্তৃপক্ষ জানানো সত্ত্বেও ঘেরাও তুলতে পুলিশ এত সময় নিল কেন? পার্থবাবুর জবাব, “পুলিশের উঁচু তলায় জানাতে পারতেন ওঁরা।”
রাজ্যের শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু আবার গোটা ঘটনাটা জানতেই না। বিস্মিত শ্রমমন্ত্রী বুধবার বলেন, “কাল থেকে এমন একটা ঘটনা চলছে, অথচ মালিক-ইউনিয়ন কেউই আমার অফিসকে কিছু জানালেন না!” এ দিন ঘটনার কথা জেনে ত্রিপাক্ষিক বৈঠক ডেকে কারখানা খোলার ব্যবস্থা করার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। সেই মতো আজ, বৃহস্পতিবার উলুবেড়িয়ার সহকারী শ্রম কমিশনারের ঘরে বৈঠক ডাকা হয়েছে।
করোনেশন ইঞ্জিনিয়ারিং নামে উলুবেড়িয়ার কারখানাটি প্রায় তিরিশ বছরের পুরনো। মূলত রফতানিযোগ্য ইস্পাতজাত পণ্য উৎপাদিত হয় এখানে। কারখানার প্রায় সাড়ে সাতশো শ্রমিকের অধিকাংশই ঠিকার ভিত্তিতে কাজ করেন। মাত্র ৬৫ জন রয়েছেন ‘পে-রোলে’। তাঁরাও দৈনিক মজুরি পান। এঁদের বেতন বৃদ্ধির দাবি থেকেই ঘটনার সূত্রপাত।
সংস্থার কর্তৃপক্ষ জানান, কারখানায় ঠিকা-শ্রমিকদের দু’টি স্বীকৃত ইউনিয়ন রয়েছে। একটি আইএনটিটিইউসি-র। অন্যটি সিটু-র। পে-রোলে দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে থাকা শ্রমিকরা কোনও ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত নন। সম্প্রতি শ্রমিকদের বেতনবৃদ্ধি নিয়ে দুই ইউনিয়নের সঙ্গে চুক্তি করেন কর্তৃপক্ষ। এই নিয়ে তাঁরা খুশি বলে জানিয়েছেন কর্তৃপক্ষ এবং দুই ইউনিয়নের নেতারা। |
কিন্তু পে-রোলে থাকা শ্রমিকেরা তাঁদের বেতনবৃদ্ধির পরিমাণ নিয়ে অসন্তোষ দেখান। এই শ্রমিকদের দাবি, বেতন বাড়ানো নিয়ে অন্যান্য বার কর্তৃপক্ষ সরাসরি তাঁদের সঙ্গে কথা বলেন। এ বার তা হয়নি। কর্তৃপক্ষের অবশ্য দাবি, এ বছরেও তাঁরা আলোচনার ভিত্তিতেই ওই সব শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ২০-৩০ টাকা পর্যন্ত বাড়িয়েছেন।
বেতন বৃদ্ধির পরে ‘পে-রোলে’ থাকা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি এখন ১৩০ টাকার মতো। সেটা ১৭৩ টাকা করার দাবি নিয়ে মঙ্গলবার কর্তৃপক্ষের কাছে যান তাঁরা। শ্রমিকদের অভিযোগ, কর্তৃপক্ষ তাঁদের বলেন, মজুরি না পোষালে তাঁরা কাজ ছেড়ে চলে যেতে পারেন। কারখানার ম্যানেজার (এইচআর অ্যান্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) অভিজিৎ বিশ্বাস বলেন, “আমরা এ বছর সব থেকে বেশি হারে বেতন বাড়িয়েছি। তার পরেও যাঁরা আপত্তি করেছেন তাঁদের বলেছিলাম, এর বেশি বাড়ানো অসম্ভব। কারও আপত্তি থাকলে কাজ না-ও করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে তাঁদের আমরা প্রভিডেন্ড ফান্ড-গ্র্যাচুইটির টাকা মেটাতে প্রস্তুত।”
এই নিয়ে বাদানুবাদের পরেই বিকাল ৪টে নাগাদ মেন গেট-সহ কারখানার বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে পড়েন ‘পে-রোলে’ থাকা শ্রমিকেরা। তাঁরা ঘোষণা করেন, অভিজিৎবাবু ছাড়াও ম্যানেজার (ফিনান্স) আশিস মুখোপাধ্যায় ও অ্যাকাউন্টস অফিসার বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়কে বাইরে যেতে দেওয়া হবে না। সেই সময় শ্রমিক-কর্মচারী মিলিয়ে আরও ৫৫ জন কারখানার ভিতরে ছিলেন। তাঁরাও আটকে পড়েন। বিক্ষোভকারীরা ‘তৃণমূল কংগ্রেস জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিচ্ছিলেন বলে জানিয়েছেন আটকে থাকা শ্রমিকরা।
কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, ঘেরাও হওয়ার পরে তাঁরা বার বার পুলিশ-প্রশাসনের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করেন। পুলিশ বার কয়েক ঘুরেও যায়। কিন্তু তাঁদের উদ্ধারের চেষ্টাই করেনি। পুলিশের যুক্তি, শ্রমিকেরা শান্তিপূর্ণ ভাবে বসেছিলেন। প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের কাছে কোনও নির্দেশও ছিল না। নির্দেশ পেতে বুধবার বিকাল ৩টে হয়ে যায়। তার পর ঘেরাও তুলতে যায় পুলিশ।
ঘেরাও চলাকালীনই বুধবার সকালে কারখানার গেটে ‘সাসপেনশন অফ ওয়ার্ক’-এর নোটিশ ঝুলিয়ে দেন কর্তৃপক্ষ। অভিজিৎবাবুর বক্তব্য, “নিরাপত্তার স্বার্থেই এই নোটিশ দিতে বাধ্য হয়েছি।” অন্য দিকে শ্রমিকদের পক্ষে সুকুমার রায় বলেন, “এত কম বেতনে আমাদের চলছিল না। সে কথা বলতে গেলে আমাদের বের করে দেওয়া হয়। তাই ঘেরাও করতে বাধ্য হই।” শ্রমমন্ত্রীরও অভিযোগ, “ওই কারখানায় শ্রমিকদের খুব কম মজুরি দেওয়া হয়।”
কারখানার দুই শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকে অবশ্য ঘেরাওয়ের নিন্দা করা হয়। আইএনটিটিইউসি-র নেতা ধনঞ্জয় গোড়া বলেন, “ওই সব শ্রমিকেরা কোনও সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত নন। যে ভাবে তাঁরা কারখানার কর্তাব্যক্তিদের ঘেরাও করলেন, তা নিন্দনীয়।” সিটু নেতা মনোরঞ্জন মাকাল বলেন, “দাবি-দাওয়া থাকতেই পারে। তা-বলে কর্তৃপক্ষকে এ ভাবে ঘেরাও করা ঠিক হয়নি।”
তৃণমূলের শ্রমিক নেতারা বিক্ষোভের সঙ্গে যুক্ত না থাকার দাবি করলেও ঘেরাওকারীরা তৃণমূলের নামে স্লোগান দিচ্ছিল কেন? পূর্ণেন্দুবাবুর ব্যাখ্যা, “মালিকের উপর চাপ তৈরির জন্য যা করার তাই ওঁরা করেছেন।” ঘেরাওকারীরা উলুবেড়িয়া (দক্ষিণ) কেন্দ্রের তৃণমূল বিধায়ক পুলক রায়ের নামও নিয়েছিলেন। যদিও শ্রমমন্ত্রীর দাবি, “পুলক ওই ঘটনায় জড়িত নন। বরং তাঁকে কেউ ঘটনার কথা জানায়নি বলে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।” |