‘আজ তাঁর কাজের কদর অনেক।’ জগদীশচন্দ্র বসুর
অসামান্য গবেষণার কথা লিখছেন পদার্থবিজ্ঞানী সোমক রায়চৌধুরী |
বায়ুরাশির কম্পনে যে রূপ শব্দ উৎপন্ন হয়, আকাশ-স্পন্দনে সেই রূপ আলো উৎপন্ন হইয়া থাকে। শ্রবণেন্দ্রিয়ের অসম্পূর্ণতা হেতু একাদশ সপ্তক সুর শুনিতে পাই। কিন্তু দর্শনেন্দ্রিয়ের অসম্পূর্ণতা আরও অধিক। আকাশের অগণিত সুরের মধ্যে এক সপ্তক সুর মাত্র দেখিতে পাই... পীত, সবুজ ও নীলালোক এই এক সপ্তকের অন্তর্ভুত। কম্পন-সংখ্যা চারিশত লক্ষ কোটির ঊর্ধ্বে উঠিলে চক্ষু পরাস্ত হয় এবং দৃশ্য অদৃশ্যে মিলাইয়া যায়। |
আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু স্বচ্ছ বাংলায় বোঝাছেন আলোর রহস্য, ‘অদৃশ্য আলোক’ প্রবন্ধে। ১৮৬০-এর দশকে কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল অঙ্ক কষে দেখালেন যে, পরিবাহকের মধ্যে বিদ্যুৎ স্পন্দিত হতে থাকলে আশপাশের মাধ্যমে এক তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়বে। তিনি দেখালেন, আলো আসলে এমনই এক তরঙ্গ। জার্মানির হাইনরিশ হার্তজ্ ১৮৮৪-তে এই তরঙ্গ তৈরি করে দেখালেন ম্যাক্সওয়েল-তত্ত্বের প্রমাণ। পৃথিবীর নানা প্রান্তের গবেষণাগারে নানা প্রকারের ‘বিদ্যুৎ-ঊর্মি’ উৎপাদনের প্রচেষ্টা শুরু হল।
জগদীশচন্দ্র বিলেতে গিয়েছিলেন ডাক্তারি পড়তে— শেষমেশ বৃত্তি পেয়ে কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাকৃত বিজ্ঞানে (ন্যাচরাল সায়েন্সেস) ট্রাইপস (বি এ) ডিগ্রির জন্য ক্রাইস্ট্স্ কলেজে পড়াশুনো শুরু করলেন ১৮৮১ সালে। কেম্ব্রিজ-এ তাঁর শিক্ষকেরা অনেকেই ছিলেন ম্যাক্সওয়েল-এর ছাত্র। তাই তাঁর বিদ্যুৎ-চৌম্বকীয় তত্ত্ব তখন সেখানকার ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবরেটরিতে মহা-আলোচিত। ম্যাক্সওয়েল-এর ছাত্র জন পয়েন্টিং তখন এই তরঙ্গের বহন নিয়ে গবেষণা করছেন। জগদীশচন্দ্রের অন্যান্য শিক্ষকের মধ্যে লর্ড র্যালে নানা ধরনের তরঙ্গ (প্রধানত শব্দতরঙ্গ) নিয়ে চর্চায় বিখ্যাত। ছিলেন ফ্রান্সিস ডারউইন, জেমস ডিওয়ার। কেম্ব্রিজের পদার্থবিদ্যার গৌরবের যুগ তখন উদয়ের পথে।
ভারতীয় বিজ্ঞানে চিরকালই তত্ত্বচর্চার কদর বেশি, বিশ্বমানের গবেষণাগার ভারতে সে তুলনায় কম। পরীক্ষাভিত্তিক গবেষণাকে ভারতীয় বিজ্ঞানমহলে অনেকে একটু নিচু চোখে দেখেন। পাশ্চাত্যে উল্টো, যন্ত্রবিদের কদর খুব। ব্রিটিশ আমলের গোড়ায় শাসকদের বিশ্বাস ছিল, ভারতীয়রা হাতে কলমে খুব একটা দক্ষ নয়।
ছোটবেলা থেকে নিজের হাতে যন্ত্রপাতি বানানো আর পরীক্ষার প্রবণতা ছিল জগদীশচন্দ্রের। সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে পড়াকালীন ফাদার লাফোঁর অসাধারণ বিজ্ঞানশিক্ষা পদ্ধতিতে চমৎকৃত হতেন তিনি। বিজ্ঞানের ক্লাসে সব সময় হাতেনাতে নানা পরীক্ষা করে দেখাতেন। কেম্ব্রিজেও লর্ড র্যালের পড়ানো এ রকম। রয়্যাল ইনস্টিটিউশনের (লন্ডন) দৌলতে তখন ইংল্যান্ডে মাইকেল ফ্যারাডে এমন পরীক্ষার মাধ্যমে পড়ানো চালু করেছেন। জগদীশচন্দ্র পরে প্রেসিডেন্সির বেকার ল্যাবে এমনই পড়ানোর ব্যবস্থা করবেন।
যন্ত্রের প্রবণতা ছোটবেলা থেকে। বাবা ভগবানচন্দ্রের গড়া অনাথ আশ্রমের শিল্পশিক্ষাকেন্দ্রে কিশোর জগদীশচন্দ্র বাড়ির ভাঙা পিতলের বাসন গলিয়ে ছোট কামান তৈরি করেছিলেন। সেই একই অনুসন্ধিৎসা নিশ্চয় এডিসন’এর সদ্য-আবিষ্কৃত ফোনোগ্রাফ যন্ত্র কিনে ব্রাহ্মসমাজের গান, বন্ধু রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠস্বর নিপুণ ভাবে রেকর্ড করার চেষ্টায়। ছবি তোলার যন্ত্র তখন নতুন, প্লেট ক্যামেরা নিয়ে প্রাচীন মন্দিরের ছবি নিজের ডার্করুমে ডেভলপ আর এনলার্জ করা তখন বাঙালির শখ ছিল না।
১৮৯৫-তে জার্মানিতে এক্স-রে আবিষ্কার করলেন ভিলহেল্ম র্যোন্টগেন। আবিষ্কারের খুঁটিনাটি পাঠ করে জগদীশচন্দ্র পাঠ করে ফেললেন এক্স-রে যন্ত্র, হাতের হাড়ের ছবি তুললেন। মেডিকাল কলেজ থেকে ডা. নীলরতন সরকার তখন হাড়-ভাঙা রোগী পাঠান জগদীশচন্দ্রের কাছে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভারতে প্রথম ভগ্ন-অস্থি’র ছবি তোলার জন্য।
ডা. দিবাকর সেনের একটি প্রবন্ধে দেখেছি আরও এক অসাধারণ ঘটনা। ১৯০৩ সালে কাছের বন্ধু রবীন্দ্রনাথের কন্যা রেণুকা অসুস্থ, শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। জগদীশচন্দ্র তাঁর পরীক্ষাগারে অক্সিজেনের মধ্যে তড়িৎমোচন করে ওজোন মিশ্রিত অক্সিজেন সিলিন্ডার তৈরি করে দিলেন কবিকন্যার জন্য।
যে বছর ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের শুরু, সেই ১৮৮৫ সালে দেশে ফিরলেন জগদীশচন্দ্র। নানা চেনা অধ্যাপকের সুপারিশে ভাইসরয় লর্ড রিপনের কাছে হাজির। প্রেসিডেন্সির মতো সরকারি কলেজে তখন দু’ধরনের চাকরি হত: আই ই এস অর্থাৎ ইন্ডিয়ান ইম্পিরিয়াল সার্ভিস-এ ভাল মাইনে, মাসে তিনশো টাকা, ইংরেজ শিক্ষকদের জন্য। প্রভিনশিয়াল সার্ভিস-এ দেশীয় শিক্ষকের মাইনে দু’শো টাকা। লর্ড রিপন জগদীশচন্দ্রকে ইম্পিরিয়াল সার্ভিস-এর জন্য সুপারিশ করলেন, মানলেন না অধ্যক্ষ টনি। লর্ড রিপন চটলেন, তিনি জোর করায় অস্থায়ী পদে চাকরি হল, মাসে একশো টাকা। ইংরেজ শিক্ষকের তুলনায় তিন ভাগের এক। প্রতিবাদে জগদীশচন্দ্র মাইনে নিলেন না। তাঁর যে তখন অবস্থা ভাল, তা নয়। বউবাজারের ভাড়া বাড়িতে মা-বাবাকে নিয়ে থাকেন। বিবাহ করবেন তার পরের বছর। বাবার ব্যবসা ঋণে ভারাক্রান্ত। জগদীশচন্দ্রের একান্ত পরিশ্রম আর কার্যক্ষমতা দেখে যখন অধ্যক্ষ টনি স্বয়ং পূর্ণ বেতনের ব্যবস্থা করলেন তিন বছর বাদে, তখন একসঙ্গে তিনি পেলেন জমা টাকা, পিতৃঋণ শোধ হল অনেকটাই।
প্রেসিডেন্সি কলেজে সপ্তাহে ছাব্বিশ ঘণ্টা ক্লাস নিতে হত জগদীশচন্দ্রকে, গবেষণার কোনও ব্যবস্থা ছিল না। তাঁকে গবেষণা কক্ষ সাজিয়ে দেওয়ার প্রশ্নই ওঠেনি। বাথরুমের পাশে ছোট্ট ঘরটিতে টেবিল পেতে গবেষণাগার স্থাপন করলেন জগদীশচন্দ্র। তাঁর যন্ত্রকলা-কুশলতায় এখানেই তৈরি হল অদৃশ্য আলোর উপোদক আর গ্রাহক যন্ত্র।
হাইনরিশ হার্তজ্আর অলিভার লজ তার আগেই ম্যাক্সওয়েল-এর তত্ত্ব অনুযায়ী এই তরঙ্গ সৃষ্টি করেছেন, তবে জগদীশচন্দ্রের অভিনবত্ব তাঁর তরঙ্গের দৈর্ঘ্য আর স্থায়িত্বে। তরঙ্গদৈর্ঘ্য যত ছোট, তত শক্তি সে তরঙ্গের, তত দূর পৌঁছতে পারার ক্ষমতা। হার্তজ্-এর তরঙ্গদৈর্ঘ্য ছিল এক মিটারের কাছাকাছি। জগদীশচন্দ্র পারলেন তা কমিয়ে এক সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্যের তরঙ্গ তৈরি করতে, যাকে আজকাল আমরা মাইক্রোওয়েভ বলি। রান্নাঘরে যে মাইক্রোওয়েভ উনুন ব্যবহার করা হয়, সে তরঙ্গের প্রথম সৃষ্টি প্রেসিডেন্সি কলেজের ওই ঘরে। জগদীশচন্দ্র সেখানে থেমে থাকেননি, কয়েক মিলিমিটার দৈর্ঘ্যের তরঙ্গ উৎপাদন ও গ্রহণের যন্ত্রও তৈরি করলেন তিনি।
এই সব আবিষ্কারের কথা ক্রমশ প্রকাশ পেতে থাকল বিলিতি গবেষণা পত্রিকায়। বিজ্ঞানীদের জীবনে কোনও কোনও বছর বিশেষ তাৎপর্য নিয়ে আসে। আইনস্টাইনের যেমন ১৯০৫, জগদীশচন্দ্রের তেমনই ১৮৯৫ ‘আনুস মিরাবিলিস’ আশ্চর্যের বছর। সে বছর প্রকাশিত পাঁচটি গবেষণা প্রবন্ধে প্রকাশিত হল তাঁর কাজের মূল বিবরণ।
জগদীশচন্দ্র লিখলেন, ‘অদৃশ্য আলোক ইট পাটকেল, ঘরবাড়ি ভেদ করিয়া অনায়াসেই চলিয়া যায়। সুতরাং ইহার সাহায্যে বিনা তারে সংবাদ প্রেরণ করা যাইতে পারে।’ কলকাতার টাউন হলের জনসমক্ষে বাংলার লেফটেনান্ট গভর্নর স্যর উইলিয়ম ম্যাকেঞ্জির ‘বিশাল দেহ’ ও দুই দেওয়াল ভেদ করে পাশের ঘরে বিস্ফোরণ ঘটালেন বোতাম টিপে। একই পরীক্ষা বক্তৃতার সঙ্গে দেখালেন ১৮৯৬-৯৭’এ ইউরোপ সফরে: গ্লাসগো, লন্ডন, প্যারিস।
শুধু নতুন ধরনের অদৃশ্য আলো তৈরি করার জন্যই কিন্তু জগদীশচন্দ্রকে আজকের বিজ্ঞান সমাজ পথিকৃতের আসনে বসাচ্ছে না। এই কাজে তাঁর যন্ত্রনৈপুণ্যের ফলে যে অভিনব উদ্ভাবন, তা আজও আমরা নানা ক্ষেত্রে ব্যবহার করি। তরঙ্গ উৎপাদনের পর তা যাতে স্থায়ী হয়, এবং যাতে একটি নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্যের তরঙ্গ উৎপাদিত হয়, তার উপায়ও বার করলেন তিনি। আর গ্রাহক যন্ত্রের জন্য যে সব উদ্ভাবন, তার থেকে আমরা আজ পাই অর্ধপরিবাহী বস্তু (সেমি-কন্ডাকটর), গ্যালেনা ক্রিস্টাল দিয়ে তৈরি ডায়োড, হর্ন অ্যান্টেনা, তরঙ্গবাহী ওয়েভগাইড, জোড়া প্রিজমের অ্যাটেনুয়েটর এ সবের অনেক কিছুই বিশ শতাব্দীর শেষের দিকে নানা প্রযুক্তিতে কাজে লাগতে শুরু করে।
জগদীশচন্দ্র ভুল শতাব্দীতে জন্মেছিলেন। আজ তাঁর কাজের কদর অনেক। ১৫ সেপ্টেম্বর তাঁর এই কাজের সম্মানেই প্রেসিডেন্সি কলেজের দেওয়ালে ‘ইনস্টিটিউট অব ইলেকট্রিকাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ার্স’-এর প্রধান নিজে এসে স্মৃতিফলক বসাবেন। |