কোনও দেশের সব পুরুষ যদি বাড়ির মহিলা রাঁধুনিকে বিবাহ করিবার সিদ্ধান্ত করেন, তাহার ফল কী হইবে? এক বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ বলিয়াছিলেন, সমাজের উপর এই সিদ্ধান্তের কী প্রভাব পড়িবে তাহা বলা কঠিন, কিন্তু অর্থনীতির বৃদ্ধির হার কমিবেই। কেন? রাঁধুনি গৃহস্থ বাড়িতে কাজ করিয়া মাসান্তে যে বেতন পান, তাহা জাতীয় উৎপাদনের অংশ। কিন্তু, গৃহকর্তা তাঁহাকেই বিবাহ করিয়া পত্নীর আসনে বসাইলে তিনি সেই খাটুনিই খাটিবেন সম্ভবত বেশিই খাটিবেন কিন্তু বিনা বেতনে। ফলে, জাতীয় আয় হ্রাস পাইবে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা এই প্রশ্নটিকে সম্পূর্ণ ঘুরাইয়া দেওয়ার একটি পরিকল্পনা করিতেছে প্রস্তাব আসিয়াছে, স্বামীর বেতনের একটি নির্দিষ্ট অংশ প্রতি মাসে তাঁহার স্ত্রীকে ‘বেতন’ বাবদ দেওয়া হইবে। গৃহকর্মের বেতন। ভারতের জাতীয় আয় গত বৎসর, ভারতের অনতিসাম্প্রতিক অতীতের নিরিখে, প্রায় বাড়ে নাই বলিলেই চলে। এই বৎসর সম্ভবত সেইটুকুও বাড়িবে না। তাহা লইয়া সরকারি কর্তাদের দুশ্চিন্তার শেষ নাই। মন্টেক সিংহ অহলুওয়ালিয়া গৃহবধূদের বেতনের প্রস্তাবটি আইনে রূপান্তরিত করাইবার দায়িত্ব লইতে পারেন। তাহাতে জাতীয় আয়ের বৃদ্ধি-হার বাড়িবে। মনমোহন সিংহের মুখে হাসি ফুটিবে।
বাঙালি হিন্দু বিবাহে একটি রেওয়াজ আছে: বিবাহার্থে রওয়ানা হইবার পূর্বে পাত্র তাঁহার মাকে বলিয়া যান, ‘মা, তোমার জন্য দাসী আনিতে যাইতেছি’। সমস্যা হইল, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল ভারতীয় পরিবার এই কথাটিকে বড় বেশি আক্ষরিক অর্থে বিশ্বাস করিয়া ফেলিয়াছে। ফলে, বাড়ির বউরা উদয়াস্ত খাটিয়াই চলেন। অথচ, তাঁহাদের নিকট যদি জানিতে চাওয়া হয় তাঁহারা কী করেন, অধিকাংশ বধূই নতমুখে উত্তর করিবেন, কিছুই নহে। সমাজ বাড়ির কাজকে খাটো করিয়া দেখিতে শিখাইয়াছে, হতভাগ্য মেয়েগুলিও সেই ধারণাকে প্রশ্ন করিবার সাহস করেন নাই। তাঁহারা যে ‘কিছুই করেন না’, এই কথাটি পরিবারও সাগ্রহে বিশ্বাস করে। ফলে, উদয়াস্ত খাটিয়াও খাটো হইয়া থাকাই তাঁহাদের জীবন। বর্তমান রাজনৈতিক বিশুদ্ধতার যুগে ‘হাউজওয়াইফ’ বা গৃহবধূর পরিবর্তে ‘হোম মেকার’ শব্দটির প্রচলন হইয়াছে। তাহাতে অবস্থা বদলায় নাই। গৃহবধূদের মাসিক বেতনের ব্যবস্থা হইলে, এবং বেতন যাঁহাতে তাঁহাদের হাতে পৌঁছায় সেই ব্যবস্থা করিতে পারিলে পরিস্থিতি বদলাইবে। অন্তত, নারী ক্ষমতায়নের বিভিন্ন উদাহরণ ইতিবাচক সাক্ষই দিতেছে।
এই ক্ষমতায়ন সম্ভব হইলে তাহাতে শুধু নারীরই কল্যাণ নহে, সমগ্র পরিবারের কল্যাণ। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গিয়াছে, পুরুষের হাতে টাকা আর নারীর হাতে টাকার ব্যবহার এক নহে। পুরুষরা অনেকেই যেখানে নেশার দ্রব্য কিনিতে বা জুয়া খেলিতে টাকা ব্যয় করেন, সেই পরিবারেই নারীর হাতে টাকা থাকিলে তাহা সন্তানের জন্য পুষ্টিকর খাদ্য কিনিতে ব্যয় হয়। গৃহকর্ম বাবদ বেতন পাইলে সেই টাকা কোন খাতে যাইবে, আন্দাজ করা কঠিন নহে। কাজেই, প্রস্তাবটি আইনে রূপান্তরিত হইলে ভবিষ্যতের ভারত অধিকতর স্বাস্থ্যবান হইতে পারে। দুইটি প্রশ্ন অবশ্য থাকিয়াই যায়।
এক, যে বিপুলসংখ্যক মানুষ অসংগঠিত ক্ষেত্রে, আয়কর জালের বাহিরে কাজ করেন, তাঁহাদের কী ভাবে এই বেতন দিতে বাধ্য করা যাইতে পারে?
দুই, স্বামীর বেতনের কত শতাংশ স্ত্রীর প্রাপ্য হইবে, তাহা কোন মাপকাঠিতে স্থির করা হইবে? অবশ্য, দুইটি প্রশ্নই সমাধানযোগ্য। সরকার প্রকৃত যত্নবান হইলে এই আইনটির সুষ্ঠু প্রয়োগ অসম্ভব হইবে না। |