দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন কী কী বিষয়ের উপর নির্ভর করে? জটিল প্রশ্ন। একটি বিষয়ে কিন্তু জটিলতা নাই, অন্তত কেন্দ্রীয় মানবম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী কপিল সিব্বলের ভাবনায়। মানবিক শাখায় উচ্চশিক্ষার ডিগ্রির সহিত অর্থনীতির উন্নয়ন কোনও ভাবে সম্পর্কযুক্ত নহে, বলিয়াছেন সিব্বল। ইতিহাস বা দর্শনে ডিগ্রি লাভ করিয়া জাতীয় উন্নয়নের পথে সহায়তা করা যায় না, ইহাই তাঁহার অভিমত। না, এই শাখার বিদ্যাচর্চা একেবারেই গুরুত্বহীন, এমন কথা তিনি বলেন নাই। যাহা বলিয়াছেন, তাহার সম্যক্ অর্থ: জাতীয় উন্নয়নের পথ মসৃণতর করিতে হইলে আরও অনেক চাকুরি-যোগ্য মানবসম্পদ প্রয়োজন, কিন্তু ইতিহাস বা দর্শনে স্নাতক ছেলেমেয়েরা অধিকাংশই তত চাকুরি-যোগ্য নহেন। সিব্বল যাহা বলিতেছেন, সংখ্যাতত্ত্ব কিন্তু চোখে আঙুল দিয়া তাহাই প্রমাণ করে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ২০১১ সালের উচ্চশিক্ষা রিপোর্ট বলে, তেতাল্লিশ শতাংশেরও বেশি ছাত্রছাত্রী স্নাতক স্তরে মানবিক শাখায় বিদ্যালাভ করিতে যান। তাঁহাদের একটি অংশ পরবর্তী কালে উচ্চতর শিক্ষায় চলিয়া যান, এবং শিক্ষাক্ষেত্র ও অন্যান্য বৃত্তে বিশেষ কৃতিত্ব দেখান। কিন্তু সেই অংশটি নিতান্তই ছোট। বি এ পাশ ছাত্রছাত্রীর বড় অংশটিই পরবর্তী কালে উপার্জনক্ষম হইতে পারেন না, কেননা স্নাতক-পরিচয়ের ভিত্তিতে বাজারে যে সব চাকুরি পাওয়া যায়, তাহার ন্যূনতম যোগ্যতামানও ইঁহাদের অধিকাংশই পূর্ণ করিতে পারেন না।
সুতরাং, সিব্বলের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় তাতিয়া উঠিয়া মানবিক বিদ্যাচর্চার গুণ ও মাহাত্ম্য বর্ণনা করিবার চেষ্টা অনর্থক। মানবিক বিদ্যাশিক্ষা না থাকিলে যে সভ্যতা হইতে সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতির বোধ হারাইয়া যাইবে তাহাই নহে, এমনকী অর্থনীতি বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির মতো বিষয়ের বিশ্লেষণ ও ব্যঞ্জনাও বিনষ্ট হইবে, ইহা পুরাতন প্রজ্ঞা, একবিংশ শতকের বিতর্কযোগ্য বিষয় নহে। বিতর্কের বিষয় সম্পূর্ণ অন্যত্র। সিব্বলের বক্তব্য প্রসঙ্গে যাহা ভাবিয়া দেখা দরকার কেন এ দেশে ইতিহাস বা দর্শনে স্নাতক হইয়াও এত লোককে চাকুরির জন্য ন্যূনতম যোগ্যতার মানদণ্ডে পিছাইয়া থাকিতে হয়? ইংরেজি ভাষার জ্ঞান, কিংবা কম্পিউটার দক্ষতা, কিংবা সাধারণ জ্ঞান, কিংবা সংখ্যা লইয়া নাড়াচাড়া করিবার ন্যূনতম ক্ষমতা: এই সবের সহিত কি মানবিক বিদ্যাশিক্ষার এতই দূরত্ব? এতই আড়াআড়ি?
বিদেশে কিন্তু মানবিক বিদ্যাশিক্ষার এত দুঃসহ হাল নহে। ভাষার বাধ্যতামূলক জ্ঞানের কথা ছাড়িয়া দিলেও, যুগোপযোগী কম্পিউটার শিক্ষা কিংবা সাধারণ জ্ঞান, এমনকী সামান্য পরিমাণ অঙ্কও, বিদ্যাচর্চার মধ্যে নানা ভাবে জড়াইয়া রাখার দৃষ্টান্ত সেখানে দেখা যায়। স্নাতক স্তরে মূল বিষয়ের পাশাপাশি অন্যান্য নানা বিষয়ের সন্নিধানের কারণে ইহা সম্ভব হয়। সম্ভব হয় অন্ধ মুখস্থবিদ্যার পরিবর্তে ভিন্ন ধরনের মূল্যায়নের জন্যও। এই সব শর্তের যথার্থ ব্যবহারের মাধ্যমেই কিন্তু চিন উচ্চতর গবেষণায় তুমুল সফল না হইয়াও চাকুরিযোগ্য স্নাতক তৈরিতে বহু দূর আগাইয়া গিয়াছে। অথচ ভারতের স্নাতক শিক্ষা-পরিকাঠামো এই সব কয়টি ক্ষেত্রেই অসামান্য রকম পশ্চাৎপদ, এবং ফলত, গবেষণা কিংবা চাকুরি দুই ক্ষেত্রেই বিশেষ ভাবে অসফল। এখানকার মানবিক শাখার ছাত্রছাত্রীদের অধিকাংশই সারস্বত উৎকর্ষের স্বাদও পান না, আবার পড়া ও পড়ানোর নিকৃষ্টতার কারণে সাধারণ চাকুরিযোগ্যতার মানেও পৌঁছাইতে পারেন না। দুই নৌকাই ডুবিলে পা থাকিবে কোথায়? মানব হইতে মানবসম্পদে উত্তরণের পথ মিলিবে কী ভাবে? সিব্বল নিজের অননুকরণীয় ধরনে বলিয়া অতিরিক্ত ধাক্কা দিয়াছেন, কিন্তু ভুল বলেন নাই। |