দুর্গাপুজোর মুখে কারিগর ও শ্রমিকের অভাবে সঙ্কটে পড়েছেন প্রতিমা শিল্পীরা। নদিয়ার কুমোর পাড়ায় কর্মী অভাবে নাজেহাল মৃৎশিল্পীরা। কৃষ্ণনগরের ঘূর্ণি থেকে নবদ্বীপ সর্বত্রই মওকা বুঝে বেমক্কা মজুরি হাঁকছেন শিল্পীর জোগানদাররা। ফলে পুজো মরসুমে দৈনিক মজুরির হার দেড়শো থেকে তিনশো টাকা পর্যন্ত বাড়িয়েও অবস্থা সামাল দিতে হিমশিম কুমোরপাড়া।
মৃৎশিল্পীদের কথায়, মাটি তৈরি থেকে বিচুলি বাঁধা ও প্রতিমার চালা বাঁধার মত সাধারণ কাজের মজুরি তিনশো টাকা। প্রতিমা শিল্পীদের সহযোগী কারিগর হিসেবে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের দিন মজুরি ৫০০ টাকা এবং তাঁদের ন্যূনতম তিন মাসের চুক্তিতে কাজে নিয়োগ করতে হচ্ছে। পুজো এগিয়ে আসার সঙ্গে বাড়তে থাকবে ওই মজুরির হার।
বর্তমানে অবস্থা এমন পর্যায়ে গিয়েছে যে বর্ধিত মজুরির হার মেনে নিয়েও প্রয়োজনীয় সংখ্যক কর্মীর অভাবে প্রতিমার ‘অর্ডার’ ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন প্রতিমা শিল্পীরা। নবদ্বীপের নামী মৃৎশিল্পী নাড়ুগোপাল দাস বলেন, “ত্রিপুরা, বালুরঘাট, মালদহ এবং নবদ্বীপ মিলিয়ে আট খানা প্রতিমা তৈরির বায়না নিয়েছি। সবগুলিই বড় বাজেটের। এর মধ্যে ত্রিপুরার তিনটি প্রতিমা তো সেখানকার শ্রেষ্ঠ পুজো বলে পরিচিত। কিন্তু কর্মী অভাবে সময় মত প্রতিমা তৈরি করে আয়োজক সংস্থাদের হাতে তুলে দিতে পারা নিয়েই সংশয় তৈরি হয়েছে।” অন্য এক মৃৎশিল্পী বাপী পাল বলেন, “গত বছর বারোয়ারি ও সর্বজনীন পুজোর প্রতিমা মিলিয়ে মোট ২৫টি গড়েছিলাম। এবার লোকের অভাবে ১৭টি প্রতিমা গড়তে পারছি। বাকি সব ছেড়ে দিতে হয়েছে। এতে আমাদের আর্থিক ক্ষতিও হচ্ছে।” |
কৃষ্ণনগরের প্রদীপ পাল অবশ্য বলেন, “সব ধরণের হাতের কাজে নতুন করে কেউ আসতে চাইছেন না। আমার নিজের ছেলেরাও মাটি মাখতে বা প্রতিমার চোখ আঁকার মধ্যে কোনও আবেগ খুঁজে পায় না। ফলে এই সব কাজে দক্ষ শিল্পী বা কারিগরের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। কিন্তু পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বাড়ির পুজো বা সর্বজনীন পুজোর সংখ্যা। এই অবস্থায় যারা ভাল কাজ জানেন না, তাঁরাও শিল্পী হয়ে উঠছেন। মুড়ি-মিছরি এক দর হয়ে যাচ্ছে।”
মৃৎশিল্পের সঙ্গে জড়িত কারিগরদের সাফ কথা, প্রতিমার কাজ করে সারা বছর পেট ভরে না। তাই কাজের সন্ধানে অন্য রাজ্যে পাড়ি দিতে বাধ্য হচ্ছেন তাঁরা। নবদ্বীপের মহেশগঞ্জের বাসুদেব পালের কথায়, “দুর্গাপুজোর সময়ে সব মিলিয়ে বড় জোর চার মাস কাজ থাকে। শ্রাবণ থেকে কার্তিক। দুর্গা, কালী, লক্ষ্মী, জগদ্ধাত্রী, কার্তিক পুজো আর শেষ রাস উৎসব দিয়ে। বাকি সময়ে সংসার চালানো মুশকিল হয়ে যায়। তাই বাধ্য হয়ে ভিন রাজ্যে কাজের সন্ধানে যাচ্ছেন এলাকার মানুষ।”
কুমোরপাড়ায় তিন-চার মাসের চুক্তি হয়। মাসে ১০-১৫ হাজার টাকা। “চার মাসের ওই রোজগারে তো পেট ভরে না”, বলছিলেন নবদ্বীপের দিনেশ ও রমেশ পাল। গত দু’বছর ধরে সহোদর ওই দুই ভাই মহারাষ্ট্রে মাটির কাজ করছেন। তাঁদের কথায়, “গণেশ চতুর্থীর সময়ে এখানকার আড়াই গুণ আমাদের আয় হয়। একবার যারা ওই সব জায়গায় কাজ করেছেন, তারা আর কখনোই এখানে ফিরতে পারবে না।” পারিবারিক কারণে দুই ভাই নবদ্বীপে থাকলেও পুজোয় মাটির কোনও কাজ করছেন না।
ভিন রাজ্যের পাশাপাশি একশো দিনের কাজের মত নানা সরকারি প্রকল্পে হাত লাগাচ্ছেন ওই সব শ্রমিকেরা। ভালুকার দিলীপ বিশ্বাস বলেন, “আমি নিজে ১৪ বছর বয়স থেকে মাটির কাজ করছি। এখন নিজেই প্রতিমা সম্পূর্ণ গড়তে পারি। গত বছর থেকে আর মাটির কাজ করছি না। বদলে দৈনিক ২০০ টাকা রোজে রাজমিস্ত্রীর জোগানের কাজ করি। সকাল সাড়ে ৮টা থেকে সাড়ে তিনটের মধ্যে কাজ শেষ হয়ে যায়। সারা বছর বাঁধা কাজ।”
একই কথা বলেন স্বরূপগঞ্জের মধুসূদন কর্মকার। তাঁর কথায়, “১০০ দিনের কাজ শুরু হওয়ার পরে পাল বাড়ির কাজে কে যাবে? ভোর থেকে শুরু বেলা ১০টার মধ্যে কাজ শেষ। রোজগার দেড়শো টাকা পর্যন্ত। ভাল কর্মী হলে ২০০ টাকা পর্যন্ত আয় হতে পারে। তার পরে সারা দিন চাইলে অন্য কাজও করা যায়। তাই রাত জেগে কাদা-মাটি মেখে প্রতিমা গড়ার কাজে আর যাই না।” সব মিলিয়ে কর্মীর আকালে স্বস্তিতে নেই নদিয়ার কুমোরপাড়া। |