নাগপঞ্চমীর সন্ধ্যা গড়িয়ে মধ্য রাত। নদিয়ার গেদে সীমান্তের প্রত্যন্ত গ্রাম দক্ষিণপাড়া কিন্তু তখনও জেগে। অনেক দিন পরে গ্রামে কবিগানের আসর বসেছে। নিজে গাইতে না পারলেও উপস্থিত রয়েছেন ৮৬ বছরের বৃদ্ধ প্রবীণ কবিয়াল দশরথ বিশ্বাস। মূলত তাঁরই উদ্যোগে মনসাপুজো উপলক্ষে বসেছে কবিগানের আসর।
এ বারে বৃষ্টি নেই। তাই খোলা আকাশের নীচে বসেছে আসর। চারপাশে গোল করে ঘিরে রয়েছেন গ্রামের নারী পুরুষ। মাঝখানে ঝুলছে ইলেক্ট্রিকের জোরালো বাতি। সাদা ধবধবে পাঞ্জাবী, ধাক্কা পাড়ের কোঁচানো ধুতি, গায়ে রেশমী চাদর। দুই কবিয়ালের লড়াইয়ে উত্তপ্ত প্রাঙ্গণ। প্রেক্ষাপট দ্বৈপায়ন হ্রদ। দুর্যোধন সেখানে আত্মগোপন করে রয়েছেন। তাঁর সঙ্গে চলছে কৃষ্ণের প্রশ্ন-উত্তর। গ্রামীণ কবিয়ালের তার সপ্তকে বাঁধা রেওয়াজি গলায় তীব্র উচ্চারণে সেই গ্রামের মাটিতে নেমে আসে ধ্রুপদী দুই চরিত্র।
গ্রামের মানুষ মুগ্ধ হয়ে শোনেন। তাঁদের গতানুগতিক জীবনে এ বড় পালা বদল। এর জন্যই অপেক্ষায় থাকেন তাঁরা। মহাকাব্যের দুই নায়কের পক্ষ নেন তাঁরা। রাত গড়িয়ে যায়। তৃপ্ত মনে যখন ফেরেন, মহাকাব্যের রেশ থেকে যায় মনের কোণে।
সেই তৃপ্তির লেখক বেদব্যাস নন। সামান্য হাজার আড়াই মতো টাকা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়ে কবিয়াল যখন নিজের বাড়ির রাস্তা ধরেন, তিনিও পেরিয়ে এসেছেন অনেকটা পথ। ধ্রুপদী মহাকাব্যকে তিনি বেঁধেছেন তাঁর লোকায়ত ভাষ্যে, অমিতাক্ষরের অনায়াস রূপান্তর ঘটিয়েছেন পয়ারে। সেই তৃপ্তিটুকু তাঁকে তাড়িয়ে বেড়ায়।
কবিয়াল তুফান বিশ্বাস আর কবিয়াল মুকুল ভট্টাচার্য বলছিলেন, “সেই আনন্দটুকুই আমাদের খিদে মেটায়।” সেই টানেই বেরিয়ে পড়েছিলেন কোন ছোটবেলায়। কাহিনির টান। কালীগঞ্জের ছোট ইটনা গ্রামে রবিবার নদিয়ার বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা কবিয়ালেরা নিজস্ব সভায় মিলিত হয়ে সেই আনন্দের কথাই আলোচনা করছিলেন।
কিন্তু সময় বদলেছে। ইন্টারনেট আর স্যাটেলাইট টেলিভিশনের কালে কথাকারের মুখে কাহিনির সেই টান যেন অদৃশ্য। কবি গানের অস্তিত্বই প্রায় লোপ পাওয়ার পথে। তবু নদিয়া-মুর্শিদাবাদে পারিবারিক ভাবে সেই টান এখনও রয়ে গিয়েছে। মুকুলবাবু বলেন, “গাঁ ঘরে পুজো করে পেট চালাই। নেশা আর পেশা এক করে নেওয়ার সময়টাই আর নেই।” অ্যান্টনি কবিয়াল, মুকুন্দ দাস, ভোলা ময়রা, গুমানি দেওয়ানদের উত্তরাধিকারীদের সেই সম্মানও নেই। তাই নেই গান শিক্ষার সেই শিক্ষক এবং পরিবেশ। তবু কবিগান টিমটিম করে রয়ে গিয়েছে গ্রামীণ বিনোদনের ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ধরে। অনেক জায়গায় এখনও বিভিন্ন উৎসবে কবিগানের রেওয়াজ রয়ে গিয়েছে। কিন্তু সেখানে ছ’সাত ঘণ্টার আসরের পরে মেলে ১৮০০ থেকে ২৫০০ টাকা। যা ভাগ হয় সকলের মধ্যে। বছরে খুব বেশি হলে মেলে ৩০-৩৫টা আসর।
কিন্তু কবিগানে এই যে পুরাণ মহাকাব্যের নিজস্ব রূপ তৈরি হয়ে গিয়েছে, নানা চরিত্র তার ধ্রুপদী পোশাকেই বদলে গিয়েছে ভিতরে ভিতরে, নিজস্ব নানা কাহিনির অজস্র সম্ভার রয়েছে, তার খোঁজ রাখলে জনসমাজেরই খোঁজ রাখা হবে, এ কথা জানেন অনেকে, মানেনও কিন্তু সংরক্ষণে উদ্যোগী হন না। তুফানবাবু বলেন, “কবিগানের শিল্পী চাপড়া সাতঘাটার দশরথ হালদারের এখন সংসার চলে না। অথচ কোনও আর্থিক সহায়তা নেই। আমাদের কথা লোকে ভুলে গিয়েছে।”
কিন্তু সবাই যে ভুলেছেন তা নয়। আর তাতে বিড়ম্বনাই বেড়েছে শিল্পীদের। রাতে যে শিল্পী কণ্ঠের দাপটে কংস বধ করেছেন, তিনি সকালে দিনমজুরি চাইতে গেলে জমির মালিক প্রণাম করে বলেছেন, ‘আপনাকে এই কাজে মানায় না।’ কিন্তু তা বললে সংসার চলে কী করে?
শুধু তাঁর রেশমী চাদরটি সযত্নে গুছিয়ে রাখেন। নির্জন নদীপাড়ে গলা সাধেন। কখনও গভীর রাতে সেই নদী পথে শোনা যায় আত্মাভিমানী স্বর‘ফিরে যাও অর্জুনজননী। কর্ণ ত্যাজিবে না রণভূমি।” |