স্কুল শিক্ষকদের গৃহশিক্ষকতা করা নিয়ে নতুন করে বিতর্ক শুরু হল। সম্প্রতি জেলাশাসকের কাছে জেলার বাসিন্দা ৩৮ জন শিক্ষকের নাম দিয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে গৃহশিক্ষকতা করার অভিযোগ আনা হয়েছে। তারপরেই নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন। জেলাশাসক অভিযোগটি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য জেলার মাধ্যমিক স্কুল পরিদর্শককে নির্দেশ দিয়েছেন। মাধ্যমিক স্কুল পরিদর্শক সেই নির্দেশ পাওয়ার পরে ওই শিক্ষকেরা যে সব স্কুলে পড়ান, সেই বিদ্যালয়গুলি থেকে ওই শিক্ষকদের গৃহশিক্ষকতা করা সংক্রান্ত তথ্য চেয়ে পাঠিয়েছেন।
সেই চিঠি পেয়ে বিভিন্ন স্কুল পরিচালন সমিতিতে দফায় দফায় শুরু বৈঠক। মাধ্যমিক স্কুল পরিদর্শক বিশ্বজিৎ বিশ্বাস বলেন, “আইনত কোনও স্কুল শিক্ষকই গৃহশিক্ষকতা করতে পারেন না। আমরা স্কুলগুলোর কাছ থেকে রিপোর্ট চেয়ে পাঠিয়েছি, কোন কোন শিক্ষক গৃহশিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত তা জানাতে। যদি দেখা যায়, কোনও স্কুলের শিক্ষক গৃহশিক্ষকতা করছেন, তা হলে তাঁর বিরুদ্ধে আইন মেনে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
অনেক স্কুলের অনেক শিক্ষকই যে গৃহশিক্ষকতা করেন, তা সকলেই জানেন। তবে কৃষ্ণনগর শহরেরই একটি প্রথম শ্রেণির স্কুলের পরিচালন সমিতির এক কর্তা বলেন, “ওই শিক্ষকেরা যে টাকার বিনিয়মে গৃহশিক্ষকতা করছেন, তা প্রমাণ করব কী করে? কোনও অভিভাবক সাক্ষ্য দেবেন না।”
কেন? ওই স্কুল কর্তার বক্তব্য, “প্রত্যেকেই তাঁদের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা নিয়ে খুবই স্পর্শকাতর। বেশিরভাগ অভিভাবক পছন্দ করেন স্কুল শিক্ষকের কাছেই তাঁদের ছেলেমেয়েদের পড়াতে। অনেক দিন ধরে পড়াতে পড়াতে অনেক স্কুল শিক্ষক খুবই জনপ্রিয় ও শ্রদ্ধেয়। তাই তাঁদের বিরুদ্ধে কোনও সাক্ষ্য পাওয়া একরকম অসম্ভব।”
কেন এই অবস্থা? কৃষ্ণনগরের একটি স্কুলের এক ছাত্রীর অভিভাবিকার বক্তব্য, “এখন পরীক্ষায় ভাল ফল করাটাই লক্ষ্য। সেই জন্য স্কুল শিক্ষক নন অথচ ভাল পড়ান এমন শিক্ষকের কদর আগে থাকলেও এখন এই প্রতিযোগিতার বাজারে তা কমছে।” সেই মত সমর্থন করে এক অভিভাবক বলেন, “স্কুল শিক্ষকেরা অভিজ্ঞ। বছরের পর বছর ধরে পড়ানোর পরে তাঁরা জানেন, কী রকম প্রশ্ন আসে এবং কী ভাবে প্রস্তুতি নিতে হয়। সেই জন্য তাঁদের কাছেই ছেলেমেয়েদের পড়াতে পাঠাতে চান অধিকাংশ অভিভাবক।” তবে আর এক অভিভাবকের বক্তব্য, “স্কুলে কেন এমন ভাবে পড়ানো হবে না, যাতে ছাত্রছাত্রীদের বাইরে পড়তে যেতে হবে? সেক্ষেত্রে যিনি পড়াচ্ছেন, তিনি তো একই বিষয় দু’বার পড়িয়ে দু’বার টাকা নিচ্ছেন।” অন্য এক অভিভাবকের বক্তব্য, “যাঁদের সামর্থ্য রয়েছে, তাঁদের ছেলেমেয়েরা গৃহশিক্ষকের কাছে পড়বে। কিন্তু যাঁদের সামর্থ্য নেই, বিশেষ করে যারা প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া, তাদের তা হলে কী হবে? অসম লড়াইয়ের মুখে পড়বে তারা? এমনিতেই পিছিয়ে শুরু করছে, আরও পিছিয়ে যাবে?”
কিন্তু এ বারেই প্রথম নয়। ২০০৭ সালে স্কুল শিক্ষকদের গৃহশিক্ষকতা বন্ধ করতে রীতিমতো কোমর বেঁধে নেমেছিলেন নাকাশিপাড়া এলাকার বেশ কয়েক জন যুবক। টানা চার দিন বেথুয়াডহরি বাসস্ট্যান্ডের সামনে অনশন করেছিল ৯ জন আন্দোলনকারী। কয়েকজন অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁদের সমর্থনে এগিয়ে আসেন স্থানীয় বাসিন্দা ও ব্যবসায়ীদের একটি বড় অংশ। তাঁরা টানা ৬ ঘণ্টা ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক অবরোধ করে রাখেন। সেই বিক্ষোভের পরে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতি পাওয়ার পরে আন্দোলন তুলে নেন তাঁরা।
কিন্তু স্থানীয় বাসিন্দাদের বক্তব্য, পরিস্থিতির কোনও পরিবর্তনই হয়নি। সেই দিনের সেই নাকাশিপাড়া প্রাইভেট টিউটর অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালন সমিতির সদস্য অনুপ ঘোষ বলেন, “সকলের চোখের সামনে আইন অমান্য করে সেই সব স্কুল-শিক্ষকেরা এখনও গৃহশিক্ষকতা করছেন। আইনের রক্ষকদের প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়েই এই কাণ্ড হয়ে চলেছে।”
তবে কৃষ্ণনগর হাইস্কুলের প্রধানশিক্ষক উৎপল ভট্টাচার্য বলেন, “বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারেই পরিচালন সমিতির বৈঠক করেছি। এই বিষয়ে রিপোর্ট তৈরি করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়ে দেব।”
কী বলছেন শিক্ষকেরা? এবিটিএ-র নদিয়া জেলা কমিটির সম্পাদক রঞ্জিত মণ্ডল বলেন, “আমরা শিক্ষকদের গৃহশিক্ষকতার নীতিগত ভাবে বিরোধী। তবে আইন কার্যকর করার দায়িত্ব যাঁদের উপরে, তাঁরা নিষ্ক্রিয় থাকেন বলেই এমনটা ঘটে।” তৃণমূলের শিক্ষা সেলের জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিমলেন্দু সিংহ রায়েরও বক্তব্য, “আইনত শিক্ষকেরা গৃহশিক্ষকতা করতে পারেন না। যদিও অভিভাবকদের চাপে পড়ে অনেক সময়ে গৃহশিক্ষকতা করতে বাধ্য হন। তবে এটা বলব, সকলেরই উচিত আইন মেনে চলা।” |