এক দিকে কড়া আত্মসমালোচনা। সেই সঙ্গেই ‘গণপ্রতিরোধে’র আহ্বান। আরামবাগে সিপিএমের কর্মিসভায় এই বার্তাই দিলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। যে বার্তায় সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য বুদ্ধবাবু দলীয় কর্মীদের পরামর্শ দিলেন, আত্মসমালোচনার পথে ভুল শুধরেই হারানো জমি ফিরে পেতে হবে।
নাম না-করেই দল থেকে বহিষ্কৃত প্রাক্তন সাংসদ তথা আরামবাগের দাপুটে নেতা অনিল বসুর জমানাকে রবিবার তুলোধোনা করেছেন বুদ্ধবাবু। বলেছেন, নেতৃত্ব করতে করতে কিছু নেতা-কর্মীর মাথায় ‘প্রভুত্ব’ করার মানসিকতা ঢুকে গিয়েছিল! বিরোধীদের কণ্ঠরোধ করাও ছিল ‘মারাত্মক ভুল’। এই ভুলের পুনরাবৃত্তি বন্ধে সতর্ক হওয়ার পরামর্শের পাশাপাশিই ‘গণপ্রতিরোধে’র কথা বলেছেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী।
তবে তার আগে বুদ্ধবাবুর কনভয়কে এ দিনের সভাস্থল, রবীন্দ্রভবনে ঢুকতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। তৃণমূলের প্রচুর কর্মী-সমর্থক আগে থেকেই হাজির হয়েছিলেন এলাকায়। দলের পতাকা না-থাকলেও ‘বুদ্ধবাবু গো-ব্যাক’ ধ্বনি ওঠে। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশে ভেসে আসে নানা কটূক্তি, গালিগালাজ। তাঁকে কালো পতাকা, চটি-জুতো দেখান অনেকে। পর্যাপ্ত পুলিশ কর্মীও দেখা যায়নি। রবীন্দ্রভবনের পাশেই আরামবাগ হাসপাতাল মোড়। সিপিএমের কর্মিসভা চলাকালীন সেখানে জমায়েত হন তৃণমূল নেতা-কর্মীরা। গোলমালের আশঙ্কায় এ দিন কর্মিসভা শেষ হওয়ার বেশ খানিক ক্ষণ পরে সভাস্থল ছাড়েন সিপিএম নেতারা। দলের হুগলি জেলা সম্পাদক সুদর্শন রায়চৌধুরীর অভিযোগ, খানাকুল-গোঘাট থেকে আসতে তৃণমূলের বাধার মুখে পড়তে হয়েছে তাঁদের কর্মীদের। সকলে নিরাপদে বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত নেতারা সে জন্যই রবীন্দ্রভবনে অপেক্ষা করেছেন। সিপিএমের কর্মিসভায় সাধারণত সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার থাকে না। সেই নিয়ম ভেঙে এ দিন দলের নেতারাই সাংবাদিকদের ডেকে নেন রবীন্দ্রভবনের ভিতরে। সুদর্শনবাবু বলেন, “বাইরে ওরা বলছে, বুদ্ধবাবু নাকি দুষ্কৃতীদের প্রশিক্ষণের জন্য এখানে এসেছেন! আপনারাই দেখে যান, উনি কী জন্য এসেছেন।” |
তৃণমূল নেতৃত্ব অবশ্য বিক্ষোভের দায় নেননি। তাঁদের দাবি, দলের তরফে কেউ রবীন্দ্রভবন চত্বরে জমায়েত হননি বা বুদ্ধবাবুর বিরুদ্ধে স্লোগান দেননি। দীর্ঘ দিন ধরে সিপিএমের অত্যাচারে অতিষ্ঠ আরামবাগের মানুষই ‘স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে’ বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। তৃণমূল নেতা দিলীপ যাদব বলেন, “দলের কড়া নির্দেশ ছিল, কেউ অশান্তি করতে পারবে না। তার পরেও এ ধরনের অভিযোগ থাকলে খতিয়ে দেখে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” প্রসঙ্গত, ২০০৯ সালে তৎকালীন রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সভা করতে এসেছিলেন আরামবাগে। কাবলে মোড়ে তাঁর কনভয় আটকাতে চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছিল সিপিএম। পুলিশকে লাঠি চালিয়ে পরিস্থিতি সামলাতে হয়।
আরামবাগ এলাকায় অধুনা শাসক দলের ‘সন্ত্রাসে’র প্রসঙ্গ টেনেই বুদ্ধবাবু এ দিন বলেন, “এই যে অবস্থাটা চলছে, আমরা কী করব? আমাদের সামনে বিকল্পটা কী? এক নম্বর পথ, গণপ্রতিরোধ। দু’নম্বর পথ, গণপ্রতিরোধ। শেষ কথা গণপ্রতিরোধ।” কিন্তু সেই পথে যে রাতারাতি ‘পরিবর্তন’ আসবে না, তা-ও কর্মীদের মনে করিয়ে দেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর কথায়, “গণপ্রতিরোধ হঠাৎ কাল সকাল থেকে শুরু হয়ে যাবে, এমনটা হয় না! মানুষ আস্তে আস্তে বুঝবেন, কোনটে ঠিক। কোনটে ভুল। মানুষের মধ্যে লাগাতার কাজ করে যেতে হবে।” একই সঙ্গে বলেছেন, “এই সরকার হঠাৎ খসে পড়ে যাবে না! ধারাবাহিক সংগ্রামের মধ্যে এগোতে হবে।”
জেলা, জোনাল বা শাখা কমিটির কর্মীরাই শুধু নন, রাজ্য নেতৃত্বেরও ‘আত্মসমালোচনা’ প্রয়োজন বলে এ দিন মন্তব্য করেন তিনি। হুগলি জেলার আরামবাগ বিগত কয়েক দশক ধরে সিপিএমের শক্ত ঘাঁটি ছিল। কিন্তু বিধানসভা ভোটের পরে বাম-শিবির এখানে কোণঠাসা (গোটা মহকুমায় একমাত্র গোঘাট আসনটি এখনও বামেদের দখলে)। বিগত জমানায় আরামবাগে ‘বাম সন্ত্রাসে’র বিরুদ্ধে লাগাতার সরব হত তৎকালীন বিরোধীরা। সেই অতীতের দিকে ইঙ্গিত করেই বুদ্ধবাবু এ দিন বলেন, “আরামবাগে কিছু ভুল হয়েছিল। কিছু লোকের মাথায় ঢুকে গিয়েছিল, আমি তো প্রভু! মাথায় চেপেছিল, প্রভুত্ব করব। শাসন করব। কিন্তু মানুষ এটা কখনও পছন্দ করেন না।” এই সূত্রেই সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্যের আরও মন্তব্য, “প্রভুত্ব করতে করতে আরও একটা ভুল হয়েছিল। বিরোধীদের কথা বলতে দেব না, কাজ করতে দেব না এটা মারাত্মক ভুল। এই ভুল যেন কোনও ভাবেই আর না হয়। যে জমি হারিয়েছি, তা ফিরিয়ে আনতে গেলে এই ভুল আর চলবে না।”
বস্তুত, সিপিএম দীর্ঘ দিন ধরেই আরামবাগ মহকুমা এলাকায় একচ্ছত্র আধিপত্য করেছে। মহকুমার চারটি বিধানসভা আসন ছিল বামেদের দখলে। ৬৪টি পঞ্চায়েতের সব ক’টি পঞ্চায়েত এখনও বামেদের হাতে। আরামবাগ লোকসভা আসন থেকেই রেকর্ড ভোটে (প্রায় ৬ লক্ষ) ভোটে জয়ী হয়েছিলেন অনিলবাবু। খুন-জখম-অগ্নিসংযোগ-বিরোধীদের কার্যালয় দখলেরর ভূরি ভূরি অভিযোগ বহু দিন থেকেই উঠেছে এই এলাকার সিপিএম নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে।
বিধানসভা ভোটের পরে এখন আবার উল্টো চিত্র। তৃণমূলই এলাকায় ক্ষমতাশালী। ক্রমশ কোণঠাসা সিপিএম। বিরোধীদের মুখ খুলতে দেওয়া হয় না বলে এখন তৃণমূলের বিরুদ্ধে সিপিএমের বিস্তর অভিযোগ। সব মিলিয়ে আরামবাগের ‘রাজনৈতিক সংস্কৃতি’র যে বিশেষ পরিবর্তন হয়নি, এ দিনের আরামবাগই তার প্রমাণ! |