চিনের একটি ওয়েবসাইট সপ্তাহখানেক পূর্বে একটি ‘অসামান্য’ পর্যবেক্ষণ প্রকাশ করিয়াছিল। তাহাদের মতে, ভারতীয় মহিলাদের কৃষ্ণ গাত্রবর্ণেই সোনার গহনার প্রকৃত মহিমা ফুটিয়া উঠে। ফলে, ভারতীয় নারীমাত্রেই সর্ব ক্ষণ গহনা পরিয়া থাকেন। এমনকী, পথপার্শ্বে কাগজ কুড়াইয়া যাঁহাদের জীবিকানির্বাহ হয়, তাঁহারাও সোনার গহনা না পরিয়া বাহির হন না! চিনের এই সদ্যলব্ধ দিব্যজ্ঞানটিকে হাসিয়া উড়াইয়া দিবার পূর্বে আর এক বার ভাবিয়া দেখা যাক। সোনার প্রকৃত জৌলুস কি কৃষ্ণ পটভূমিতেই প্রকাশিত হয়? দৃশ্যগত ভাবে কথাটিতে দ্বিমত পোষণ করিবার অবকাশ নাই। সোনার হাতে সোনার কাঁকন নেহাতই কবিকল্পনা। যে কোনও স্বর্ণকারের দোকানে উঁকি দিলেই দেখা যাইবে, যে ম্যানেকুইনগুলির গায়ে গহনা সাজাইয়া রাখা হয়, সেগুলি কৃষ্ণবর্ণের। কিন্তু, এহ বাহ্য। বিশ্ব অর্থনীতির অবস্থা যত তমসাময় হইতেছে, ততই কি সোনার জৌলুস বাড়িতেছে না? ইউরোপের অর্থনীতি বিপর্যস্ত হইলে, বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নূতন দফায় টাকা ছাপাইবার ব্যবস্থা হইলেই সোনার দাম বাড়িতেছে। এই দুনিয়ায় সোনার দামের তুলনা একমাত্র উসেইন বোল্ট। আর কেহ এত দ্রুতগামী নহে। আর কেহ এত নূতন নূতন রেকর্ড তৈরি করিতে পারে না।
টাকাকে অলস বসাইয়া রাখিলে তাহার দাম কমে। কারণ, মূল্যস্ফীতি থামিয়া থাকে না। ফলে, হাতের টাকা বিনিয়োগ করিতেই হয়। অর্থনীতি যখন সুস্বাস্থ্যের অধিকারী থাকে, তখন বিনিয়োগের প্রচুর রাস্তা খোলা থাকে। শেয়ার বাজারে টাকা খাটানো চলে। পেট্রোলিয়ামের বাজারে টাকা রাখা যায়। আর হাতের পাঁচ মার্কিন মুদ্রা তো আছেই। কিন্তু, বাজার যখন ধুঁকিতেছে, তখন এই বিকল্পগুলি থাকিয়াও নাই। ভারতীয় শেয়ার বাজারের কথাই ধরা যাউক। বিশ্বব্যাপী মন্দার ধাক্কা লাগিবার পূর্বে মুম্বই শেয়ার বাজারের প্রধান সূচক সেনসেক্স প্রায় গগনচুম্বী হইয়াছিল। কিন্তু তাহার পর যে ধস নামে, সেই ধাক্কা বাজার এখনও সম্পূর্ণ সামলাইয়া উঠে নাই। গত বৎসর সেপ্টেম্বরে সূচক ১৭,০০০ এককের কাছাকাছি ছিল। এক বৎসর পরেও তাহাই আছে। সহজ হিসাবে, ভারতের শেয়ার বাজারে টাকা খাটাইলে গত এক বৎসরে লাভ (বা, ক্ষতি) যৎসামান্য। মূল্যস্ফীতির কথা মাথায় রাখিলে, অনেকখানি লোকসান। গোটা দুনিয়ার গল্পই মোটামুটি এক রকম। বস্তুত, অনেক বাজারের অবস্থাই ভারতের তুলনায় মন্দ। অন্য দিকে, মার্কিন ডলারও তাহার মহিমা হারাইয়াছে। ‘কোয়ান্টিটেটিভ ইজিং’ অর্থাৎ টাকা ছাপাইয়া পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার ব্যবস্থায় ডলারের মূল্য হ্রাস হইয়াছে। ফলে, ডলারও আর পূর্বের ন্যায় নির্ভরযোগ্য নাই। জমি-বাড়ি? ২০০৮ সালের পর তাহারও আর সেই বাজার নাই। ফলে, হাতে থাকিল সোনা। এক কালে সঞ্চিত সোনার পরিমাণের উপর দেশের মুদ্রার বিনিময়মূল্য নির্ধারিত হইত। সেই ব্যবস্থা নাই বটে, কিন্তু বিনিয়োগের মাধ্যম হিসাবে সোনার গুরুত্ব কমে নাই। বলা ভাল, অসময়ের বিনিয়োগের মাধ্যম। এখনই যেমন। বাকি সব রাস্তা বন্ধ হইয়া যাওয়ায় মানুষ সোনার উপর নির্ভর করিয়াছে, কারণ বাজারের দোলাচলে সর্বাপেক্ষা কম প্রভাবিত হয় সোনা। তাহার উপর বাজারের অবিচলিত আস্থাই তাহার প্রকৃত মূল্য। ফলে, এই দুঃসময়ের কৃষ্ণ পটভূমিকায় সোনা ঝলমল করিতেছে। সকলেই সোনায় লগ্নি করিতে উৎসাহী। ফলে, সোনার চাহিদা বাড়িতেছে। দামও বাড়িতেছে। আর দাম বাড়িবার ফলে বিনিয়োগের মাধ্যম হিসাবে সোনার গুরুত্ব আরও বাড়িতেছে। বলা চলে, আর্থিক সংকটের তমসাচ্ছন্ন বাজারে যাহা চকচক করে, তাহা একমেবাদ্বিতীয়ম্ সোনা। |