হিন্দি চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় নায়ক শাহরুখ খান নয় দিন ধরিয়া জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যের শ্রীনগর উপত্যকায় একটি নির্মীয়মাণ চলচ্চিত্রের শুটিং করিয়া ফিরিয়াছেন। তাঁহার মতো একজন মেগাস্টারের শুটিং পর্ব সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন করা সহজ ছিল না। এত জনপ্রিয় এক জন তারকার নিরাপত্তার প্রশ্নটি স্বভাবতই সংগঠক ও প্রশাসনের রাতের ঘুম কাড়িয়া লইয়াছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিরুপদ্রবে সব সাঙ্গ হইয়াছে। কাশ্মীরি দর্শক ও ভক্তদের কাছে শাহরুখ যে অভূতপূর্ব সাড়া পাইয়াছেন, তাহাতে তিনি আপ্লুত। তাঁহার আশা, অতঃপর মুম্বই চলচ্চিত্রের অনেক শুটিং পর্বই কাশ্মীরের নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক প্রেক্ষাপটে করা হইবে। এই প্রেক্ষাপটেই দীর্ঘ কাল যাবৎ ভারতীয় চলচ্চিত্রের নানা নাট্যমুহূর্ত চিত্রিত হইয়াছে। কিন্তু গত দুই দশক ধরিয়া বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাস চলচ্চিত্র নির্মাতাদের বিমুখ করিয়া তোলে, তাঁহারা দলে-দলে সুইজারল্যান্ড, মরিশাস, তাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশে শুটিং করিতে চলিয়া যাইতেন। ইতিপূর্বে আমির খানও কাশ্মীরে দলবল জুটাইয়া শুটিং করিয়াছেন, তবে সেটা ঠিক শ্রীনগর উপত্যকা ছিল না, বৌদ্ধপ্রধান লাদাখের রাজধানী লেহ্তেই চিত্রগ্রহণ হয়। শাহরুখ খানের সর্বশেষ ছবির শুটিং মূল ধারার বাণিজ্যিক ভারতীয় চলচ্চিত্রকে সরাসরি শ্রীনগর উপত্যকায় আনিয়া ফেলিয়াছে।
এই ঘটনার বার্তা একটাই। কাশ্মীর স্বাভাবিকতায় ফিরিতেছে। অস্ত্রের আস্ফালন, জঙ্গিদের হামলা, সেনাবাহিনীর জবাবি আক্রমণ, তজ্জনিত গুলিগোলা, বিস্ফোরণ, রক্তপাতকে পিছনে রাখিয়া, সান্ধ্য আইন, মিলিটারির টহল, পুলিশকে লক্ষ করিয়া নিরস্ত্র জনতার ইটপাটকেল ছোড়া এবং উত্তরে পুলিশের গুলিচালনার দমন নীতি পিছনে রাখিয়া কাশ্মীর সুস্থ, স্বাভাবিক জনজীবনে ফিরিতেছে। উল্লেখ্য, শাহরুখ কিন্তু কোনও কাশ্মীরি জেহাদির ভূমিকায় এই চলচ্চিত্রে অভিনয় করিতেছেন না, বরং জেহাদি জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ ভারতীয় সেনা-অফিসারের ভূমিকায় অভিনয় করিতেছেন। তথাপি তাঁহার শুটিং দেখিতে কাশ্মীরিদের উদ্দীপনা ও উৎসাহের অভাব হয় নাই। কাশ্মীরের বাহিরে কাশ্মীর সম্পর্কে যে ধারণা প্রচলিত, এই নিরুদ্বেগ শুটিং পর্বে তাহাও বহুলাংশে ভ্রান্ত প্রমাণিত হইয়াছে।
কাশ্মীরের স্বাভাবিক ছন্দে ফিরিয়া আসার বিষয়টি পর্যটকদের কাছ হইতে আগেই শুনা যাইতেছিল। গত বছর হইতেই পর্যটকরা ভূস্বর্গে ভিড় জমাইতে শুরু করেন। এ বছর তো ইতিমধ্যেই শারদীয় পূজাবকাশে পর্যটকদের জন্য সব হোটেল ‘বুক’ হইয়া গিয়াছে। পর্যটকরা দলে-দলে সপরিবার কাশ্মীরমুখী। ইহা অতিশয় সুলক্ষণ। অবশিষ্ট ভারতের পর্যটকদের কাশ্মীরে যাতায়াত কেবল পর্যটননির্ভর রাজ্যটির অর্থনৈতিক উন্নয়নেই সহায়ক হইবে না, দুই ভূখণ্ডের মানুষের হার্দ্যিক বিনিময় ও আদানপ্রদান মারফত অনেক পারস্পরিক ভ্রান্তি ও প্রমাদের নিরসন হইবে, পরস্পরের নিকটে আসার আকাঙ্ক্ষাও জাগ্রত হইবে। পর্যটন-নির্ভর অর্থনীতি নূতন করিয়া প্রাণ পাইবে। জীবন তাহার স্বাভাবিক ছন্দে ফিরিবে। বিচ্ছিন্ন হওয়ার আকাঙ্ক্ষা অপেক্ষা এই ছন্দের আহ্বান নিশ্চয় অধিকতর জরুরি। ইত্যবসরে আর একটি অতিরিক্ত লাভও অর্জন সম্ভব। শাহরুখ খান মুম্বই চলচ্চিত্রের কাশ্মীরে প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা প্রত্যক্ষ করিয়াছেন। চলচ্চিত্রও কাশ্মীরকে অবশিষ্ট ভারতের বাসিন্দাদের নিকটে লইয়া আসিতে পারে। কাশ্মীরের ইতিহাস, তাহার সঙ্গীত, তাহার কারুশিল্প, তাহার ধর্মীয় সহনশীলতার সুফি ঐতিহ্য, তাহার ‘কাশ্মীরিয়ত’ এক অনন্য উপাদান, যাহা ব্যতীত ঐক্যসন্ধানী ভারতীয়তা অসম্পূর্ণ থাকিয়া যায়। |