প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেন্টর গ্রুপ থেকে অধ্যাপক সুকান্ত চৌধুরীর পদত্যাগ নিঃসন্দেহে অত্যন্ত দুঃখজনক। সুকান্তবাবু প্রেসিডেন্সির প্রাক্তনী। ওই কলেজে তিনি অনেক দিন অধ্যাপনাও করেছেন। ইংরেজির বিশিষ্ট অধ্যাপক ও পণ্ডিত হিসেবে তাঁর বিরাট সুনাম। মেন্টর গ্রুপ থেকে এমন একজন গুণী ব্যক্তির বিদায় খুবই বেদনাদায়ক। তবে যে প্রশ্নে তিনি ইস্তফা দিলেন, তা যে অত্যন্ত সঙ্গত সে বিষয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। প্রেসিডেন্সির একজন প্রাক্তনী হিসেবে এই নতুন প্রতিষ্ঠানের বিশ্বমানের প্রচেষ্টাকে অবশ্যই স্বাগত জানাব। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, এ মানোন্নয়ন কী মূল্যে? আর সে মূল্য কি বড্ড বেশি হয়ে যাবে না? প্রেসিডেন্সির মানোন্নয়ন করতে গিয়ে কলকাতা, যাদবপুরের মতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলিই শুধু নয় অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলিও কি তাদের ন্যায্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হতে যাচ্ছে না? প্রেসিডেন্সিতেই শুধু ভাল ভাল শিক্ষক নিয়ে আসা হবে, অন্য কোথাও নয় এ কেমন যুক্তি? মানোন্নয়নের জন্য প্রেসিডেন্সিকে কিছুটা অগ্রাধিকার দেওয়া যেতে পারে। তবে তাও করা উচিত অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলির কথা সার্বিক ভাবে মাথায় রেখে। প্রেসিডেন্সিতে বেশি টাকা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দিলে কলকাতা ও যাদবপুর থেকে ভাল ভাল শিক্ষকরাও ওখানে চলে যাবেন না তো?
সুকান্তবাবুর পদত্যাগের পর এ সব প্রশ্ন আবার নতুন করে উঠতে বাধ্য। তিনি পরিযায়ী পাখি নন, এখানকার ‘গ্রাউন্ড রিয়্যালিটি’ সম্বন্ধে খুবই সচেতন। সে জন্যই তিনি প্রশ্নগুলি তুলেছেন। তা ছাড়া বিদেশ প্রত্যাগত হলেই এক জনের মান উঁচু হয় না। সর্বত্রই নানান রকম মানের প্রতিষ্ঠান আছে। আবার শুধু বেশি টাকা দিলেই ভাল ভাল লোক আসবে এটাও ধরে নেওয়া কেন? পঞ্চাশের দশকে আমাদের ছাত্রাবস্থায় প্রেসিডেন্সিতে প্রবাদপ্রতিম সব অধ্যাপকই তো (তারকনাথ সেন, সুশোভন সরকার, প্রফুল্লচন্দ্র রক্ষিত, ভবতোষ দত্ত, অমল রায়চৌধুরী প্রমুখ) সরকারি কলেজের বেতন পেয়েই সন্তুষ্ট ছিলেন। তার চেয়েও বড় কথা, শুধু ভাল ভাল অধ্যাপক থাকলেই কি কলেজ/ বিশ্ববিদ্যালয়ের মানোন্নয়ন হয়? ভাল ভাল ছাত্রও দরকার। আশির দশকের মধ্যভাগ থেকেই পশ্চিমবঙ্গের ভাল ভাল ছাত্রছাত্রীদের শুধু বিদেশে নয়, ভারতের অন্যত্রও যে ‘এক্সোডাস’ শুরু হয়েছে, তা বন্ধ করার উপায় কী? তাও তো ভাবতে হবে। কলেজ হিসেবে প্রেসিডেন্সির যে সুনাম ছিল, তার পিছনে যেমন অধ্যাপকদের অবদান, তেমনই ছিল ভাল ভাল ছাত্রছাত্রীর উপস্থিতি। তখন যত ভাল ছাত্রই হোক, যত সচ্ছল পরিবারেরই হোক না কেন, কলকাতার বাইরে গিয়ে পড়াশোনা করার কথা ভাবতেই পারত না। কিন্তু দিনকাল পাল্টে গেছে। এখন শুধু বিদেশে নয়, দেশেও বিভিন্ন জায়গায় ছাত্রদের অনেক বেশি সুযোগ-সুবিধা, অনেক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের হাতছানি, সে সব ছেড়ে ছাত্ররা কি কলকাতায় থাকবে? এ সব নতুন করে চিন্তা করার প্রয়োজন। এই প্রেক্ষিতে মেন্টর গ্রুপের মুখপাত্রের বক্তব্য, ‘‘সব বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব তো আমাদের দেওয়া হয়নি। আমরা প্রেসিডেন্সিকে বিশ্বমানের করার লক্ষ্যে এগোচ্ছি’’ (২৬-৮)। আমার মনে হয়, মেন্টর গ্রুপ থেকে সুকান্তবাবুর পদত্যাগের মধ্যে যে-প্রতিবাদ, তার সঙ্গে আমার মতো অনেক প্রাক্তনীই শুধু নয়অনেক চিন্তাশীল মানুষও শামিল হবেন।
সুশীল চৌধুরী। ফেলো, রয়াল হিস্টরিক্যাল সোসাইটি, ইংল্যান্ড। ভূতপূর্ব ইউ জি সি এমেরিটাস ফেলো, কলকাতা-৬৮
|
আজকাল দেখছি, শহরে, শহরতলিতে মফস্সলে এমনকী গ্রামেও পায়ে চলার পথ হারিয়ে যাচ্ছে। নিয়ন্ত্রণহীন অসংখ্য যানবাহন পায়ে চলার পথকে ক্রমশ গ্রাস করে নিচ্ছে। শহরে পায়ে চলার জন্য ফুটপাথ আছে। কিন্তু ফুটপাথ পথচারীদের জন্য নয়, অনেক আগে থেকেই অন্য কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। শহরতলি আর মফস্সলে এতই যানবাহনের যন্ত্রণা যে, পথচারীকে কায়ক্লেশে পথ চলতে হয়। আবার গ্রামে মোটর সাইকেলের উপদ্রবের সঙ্গে রয়েছে ভ্যান-রিকশা ও মেশিন-ভ্যান। শেষোক্ত দুুটি যান গোটা পথ জুড়েই চলে। ‘পথিক পথ দিয়া আপন মনে গায়িতে গায়িতে যাইতেছে।’ (বঙ্কিমচন্দ্র, একা ‘কে গায় ওই?’, ভাদ্র ১২৮০) এই দৃশ্য আর দেখা যাবে না। যেখানে নিশ্চিন্ত মনে পথ চলাই দায়, সেখানে গান গাওয়া তো দূর অস্ত্।... ‘এই তো পায়ে চলার পথ। এসেছে বনের মধ্যে দিয়ে মাঠে, মাঠের মধ্যে দিয়ে নদীর ধারে, খেয়াঘাটের পাশে বটগাছতলায়। তার পরে ও-পারের ভাঙা ঘাট থেকে বেঁকে চলে গেছে গ্রামের মধ্যে, তার পরে তিসির খেতের ধার দিয়ে, আমবাগানের ছায়া দিয়ে, পদ্মদিঘির পাড় দিয়ে, রথতলার পাশ দিয়ে কোন্ গাঁয়ে গিয়ে পৌঁছেছে জানি নে।’ (রবীন্দ্রনাথ, পায়ে চলার পথ, আশ্বিন ১৩২৬) এই অনুভূতি রূপকথাসুলভ দূরত্বে সরে গিয়েছে।
স্বপনকুমার দে। শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা-৭৩ |