দরজায় ঠেলা দিতেই দমকে দুর্গন্ধ বেরিয়ে এল। নাকে রুমাল চাপা না-দিলে ভেতরে ঢোকা কার্যত অসম্ভব। শ্যাঁওলা ধরা, পিছলে মেঝেতে মাঝেমধ্যেই আছাড় খাচ্ছেন রোগীরা। মাকড়সার ঝুলে ভরা দেওয়াল। রক্তমাখা তুলো থেকে শুরু ইঞ্জেকশন সিরিঞ্জ ইতিউতি ছড়িয়ে। ইতিউতি মলমূত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। দেখেশুনে পা ফেলতে না-পারলে কী হতে পারে তা বাবলেই শিউরে উঠতে হয়। কখনও লোডশেডিং হলে পরিস্থিতি হয়ে ওঠে পূঁতিগন্ধময়। সংক্ষেপে এটাই জলপাইগুড়ি জেলা সদর হাসপাতালের মেল সার্জিকাল পেয়িং ওয়ার্ডের ছবি। অবশ্য শুধু সার্জিকাল বিভাগ নয়, হাসপাতালের যে কোনো সাধারণ এবং পেয়িং ওয়ার্ডের শৌচাগারেরই এমন দশা। শৌচাগার থেকে বের হওয়ার দীর্ঘক্ষন পরেও নাকে ঢুকে যাওয়া দুর্গন্ধে বারবার গা গুলিয়ে ওঠে। তবে হাসপাতালে ভাল, পরিচ্ছন্ন শোচাগারও রয়েছে। যেমন, একটি শৌচাগারে দরজা ঠেলে ঢুকতেই দেখা গেল, দেওয়ালে সুগন্ধি লাগানো রয়েছে। |
মেঝেয় মার্বেল বসানো। প্রস্রাবের প্যান এবং আধুনিক কমোড ঝকঝক তকতক করছে। শৌচাগারের ভেতরেই ফিনাইলের বোতল। এক-দুবার ব্যবহার করার পরেই শৌচাগারগুলি সাফ করা হচ্ছে। শৌচাগারগুলিতে সাধারণ রোগীদের প্রবেশ নিষেধ। কারণ, ওই শৌচাগারগুলি সদর হাসপাতালের সুপার এবং স্বাস্থ্য দফতরের কর্তা এবং চিকিৎসকদের ব্যবহারের জন্য! একটাই হাসপাতাল। তা হলে দুরকম ছবি কেন, সেই প্রশ্নেই রোগী ও তাঁদের আত্মীয়স্বজন ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। সাধারণ রোগীরা বিশেষত যাদের আর্থিক স্বচ্ছলতা তেমন নেই, তারা ব্যবহার করেন বলেই কি যত্ন নিয়ে নিয়মিত সাফ সুতরো হয় না? পেয়িং ওয়ার্ডের শৌচাগারের এমন হাল কেন সেই প্রশ্নেরও সদুত্তর মেলে না। সম্প্রতি মেল সার্জিকালের পেয়িং ওয়ার্ডের শৌচাগারের বেহাল দশার বিষয়টি হাসপাতাল সুপারকে জানানো হলেও তিনি গুরুত্ব দিতে চাননি বলে অভিযোগ। শেষ পর্যন্ত রোগীর পরিবারের তরফে রাজ্যের তরফে একজন অতিরিক্ত স্বাস্থ্য অধিকর্তা পর্যায়ের অফিসারকে জানানো হয়। একইসঙ্গে জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিককেও বিষয়টি জানিয়ে দেওয়া হয়। খোদ রাজ্যের বিধানসভার স্বাস্থ্য বিষয়ক স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান রুদ্রনাথ ভট্টাচার্যের হস্তক্ষেপে ওই শৌচাগার পরিষ্কার করাতে বাধ্য হন কর্তৃপক্ষ। সংশিল্ষ্ট রোগীকে অন্য ওয়ার্ডে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। হাসপাতাল সূত্রের খবর, দিনে দু’বার সাফ করা হয়। শৌচাগারগুলি, হাসপাতালের ছোট বড় প্রায় ১৬টি ওয়ার্ডে ৩০টি শৌচাগার রয়েছে। এক-একটি ওয়ার্ডে গড়পরতা অন্তত পঞ্চাশ জন করে রোগী থাকেন। ওয়ার্ডের পঞ্চাশ জন রোগী যে শৌচাগার ব্যবহার করে তা দিনে মাত্র দু বার পরিষ্কার করা কতটা যুক্তিসঙ্গত, এই প্রশ্ন তুলেছে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলি। নিয়ম অনুয়ায়ী, প্রতিদিন ব্লিচিং পাউডার এবং ফিনাইল ছিটিয়ে বারবার শৌচাগার পরিষ্কার করার কথা। অভিযোগ, সপ্তাহে এক-দুবারের বেশি ব্লিচিং পাউডার ছেটানো হয় না। প্রতিটি শৌচাগারের জন্য দিনে গড়পরতা একটি করে ফিনাইলের বোতল বরাদ্দ থাকে। একটি বোতলেই মাসখানেক ধরে ব্যবহার করা হয়। প্রতিদিন শুধুমাত্র জল ছিটিয়েই দায়সারা পরিষ্কার করা হয় বলে রোগীদের অভিযোগ। রোগীরা ব্যবহার করে বলে সপ্তাহে একদিন কীটনাশক এবং জীবাণু মারার কাজ করার নিয়ম থাকলেও তাও না হওয়ায় প্রতিটি শৌচাগারেই জীবাণু সংক্রমণের আশঙ্কা রয়েছে। হাসপাতালের শৌচাগার পরিষ্কার করা হয় ঠিকাদার এজেন্সির মাধ্যমে. সকাল আটটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত এজেন্সির দায়িত্ব থাকে। রাতে সরকারি সাফাইকর্মীর ওয়ার্ডে থাকেন বলে জানা গিয়েছে। অভিযোগ, সন্ধের পরে কোনও শৌচাগার নোংরা হয়ে গেলে তথা কোনও রোগী শৌচাগারের মেঝেতেই মলমূত্র ত্যাগ করলেও তা পরিষ্কার করার কেউ থাকে না। ফলে সন্ধে থেকে সারা রাত নোংরা হওয়া শৌচাগার ব্যবহার করা ছাড়া অন্য রোগীদের কোনও উপায় থাকে না। হাসপাতালের সাধারণ শৌচাগারগুলি পরিষ্কার করেন একটি এজেন্সির কর্মীরা। তাঁরাই কিন্তু হাসপাতাল সুপার বা অন্য কর্তাব্যক্তিদের শৌচাগারের সাফাইয়ের দায়িত্বে রয়েছেন। তা হলে ভিন্ন চিত্র কেন? এক সাফাই কর্মীর কথায়, ‘‘সাহেবদের বাথরুমে দুর্গন্ধ থাকলে প্রচুর বকাবকি করে তা ফের সাফাই করান। অন্য জায়গা নিয়ে খুব একটা বকুনি তো খেতে হয় না।”
|