ডেঙ্গি বা ম্যালেরিয়া রুখতে পুরসভার সতর্কবাণী: ‘জল জমতে দেবেন না। ভাঙাচোরা গাড়ি রেখে জঞ্জাল বাড়তে দেবেন না।’ কিন্তু মশা দমনে যে দফতরের ভূমিকা সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, পুরসভার সেই ভেক্টর কন্ট্রোলের মূল অফিসের সামনের অংশই ভর্তি জল আর জঞ্জালে। ঢোকার মুখেই দু’টি ভাঙা গাড়ি। ওই অফিসে কর্মরত চিকিৎসক, গবেষকদের কাছে ব্যাপারটি গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে। এক গবেষকের কথায়, “এটিই মশার আঁতুড়ঘর। তার মধ্যে বসেই কাজ করতে হচ্ছে।”
মৌলালি এলাকায় কলকাতা পুরসভার স্টোর্স ও সাপ্লাই দফতরের বাড়িতেই স্বাস্থ্য দফতরের সাত নম্বর বরোর মূল কার্যালয়। তার ঠিক পাশেই ভেক্টর কন্ট্রোলের মূল অফিস। বুধবার দুপুরে সেখানে গিয়ে দেখা গেল, ভিতরে জনা কয়েক কর্মী কাজ করছেন। জমা জল ও জঞ্জাল থাকায় সমস্যা যে বাড়ছে, তা স্বীকার করে নিয়েছেন ওই বিভাগে কর্মরত পরজীবী-বিশেষজ্ঞ অতনু বন্দ্যোপাধ্যায়। |
মশা দমনের জন্য নিজেদের দেওয়া সতর্কবাণী নিজেরাই কি তা হলে মানেন না? এ প্রশ্নের কোনও জবাব দিতে চাননি ওই বিশেষজ্ঞ-চিকিৎসক। তাঁর জবাব, “আমি কিছু বলব না। যা বলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক বলবেন।” যদিও বিষয়টি খোলাখুলি স্বীকার করে নিয়েছেন মেয়র পারিষদ (স্বাস্থ্য) অতীন ঘোষ। তিনি বলেন, “এ নিয়ে আমরা বারবার পুরসভার স্টোর্স ও সাপ্লাই দফতরের কন্ট্রোলারকে বলেছি। কিন্তু কোনও কাজ হচ্ছে না।” বর্তমানে স্টোর্স ও সাপ্লাই দফতরের দায়িত্বে রয়েছেন মেয়র পারিষদ তারক সিংহ। তিনি বলেন, “ওখানে জমে থাকা জল-জঞ্জালে সত্যিই মশার চাষ হয়। মাসখানেক আগে দফতরের আধিকারিককে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়। এক বার পরিষ্কারও হয়। তার পরে পরিস্থিতি ফের যে কে সে-ই।”
ডেঙ্গি পরিস্থিতির মেকাবিলায় এ দিন কলকাতা পুরসভায় সব কাউন্সিলরকে নিয়ে একটি বৈঠক করেন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়-সহ পুর-প্রশাসনের পদস্থ আধিকারিকেরা। ওই সভায় মেয়র ও মেয়র পারিষদ (স্বাস্থ্য) ছাড়াও পুর-কমিশনার ও কয়েক জন আধিকারিক বক্তব্য রাখেন। কোনও কাউন্সিলরকে বলার সুযোগ না দেওয়ায় ক্ষুব্ধ হন বাম ও কংগ্রেস-সহ বেশ কয়েক জন কাউন্সিলর। বিরোধী দলনেত্রী, সিপিএমের রূপা বাগচী বলেন, “ডেঙ্গি নিয়েও ওরা বিরোধীদের কণ্ঠরোধ করতে চাইছে। রাজনীতি করা হচ্ছে। সঠিক তথ্য লুকনোর চেষ্টা চলছে।” কংগ্রেস কাউন্সিলর মালা রায় বলেন, “যে সব এলাকায় ডেঙ্গির প্রকোপ বেশি, সেখানকার কাউন্সিলরদের কথা শুনলে প্রশাসনেরই লাভ হত।” যদিও ওই সব বক্তব্য উড়িয়ে দিয়েছেন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়। তাঁর বক্তব্য, “কিছু তথ্য জানানোর জন্য কাউন্সিলরদের ডাকা হয়েছিল। ওঁদের কথা শোনার জন্য নয়।”
এ দিন ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে বিট্টু ঘোষ নামে এক কিশোরের মৃত্যু হয়। স্থানীয় বরো চেয়ারম্যান, সিপিএমের রাজীব বিশ্বাসের দাবি, বিট্টুর মৃত্যু হয়েছে ডেঙ্গিতে। যদিও মেয়র পারিষদ (স্বাস্থ্য) অতীন ঘোষ তা মানেননি। ই এম বাইপাসের এক বেসরকারি হাসপাতালে বাপ্পাদিত্য মাঝি নামে এক যুবক এবং দক্ষিণ কলকাতার এক নার্সিংহোমে ৯৮ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা নবনীতা মণ্ডল (৩৪) নামে এক মহিলার মৃত্যু ঘিরেও বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। দু’টি ক্ষেত্রেই স্থানীয় কাউন্সিলরেরা ডেঙ্গিতে মৃত্যু বলে দাবি করলেও স্বাস্থ্য দফতর বা পুরসভা তা স্বীকার করেনি।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় শহরে নতুন করে ১৯৫ জন ও রাজ্যে ২৯৮ জনের ডেঙ্গি ধরা পড়েছে। বেসরকারি মতে, সংখ্যাটা অনেক বেশি। গত ২৫ অগস্ট থেকে ই এম বাইপাস সংলগ্ন কিছু বেসরকারি হাসপাতালে প্রায় হাজার দেড়েক ডেঙ্গি রোগী ভর্তি হয়েছেন বলে ওই হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন। মুকুন্দপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালের কর্মী মেরি বানওয়ারার (২৬) মৃত্যু হয়েছে ডেঙ্গিতে। ওই হাসপাতাল সূত্রে খবর, ২৭ অগস্ট ওই মহিলার রক্ত পরীক্ষায় ডেঙ্গি ধরা পড়ে। পরের দিনই মৃত্যু হয় তাঁর। ১৬ মাসের একটি শিশুও ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়ে আশঙ্কাজনক অবস্থায় বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গি আক্রান্ত কয়েক জন রোগীর বিভিন্ন অঙ্গ বিকল হতে শুরু করেছে বলে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালগুলির তরফে জানানো হয়েছে। |