একেই রক্তপিপাসায় উন্মত্ত মশা, তার উপরে জীবাণুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধহীন মানবশরীর। দুইয়ে মিলেই মহানগরে এ বার ‘ডেঙ্গি-রাজ’ কায়েম হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞদের কথায় ইঙ্গিত মিলছে।
কোনও বাড়ির এক জন আক্রান্ত হলে বাকিরাও চটজলদি কাবু হয়ে পড়ছেন। ক’দিনের মধ্যে রোগ এক বাড়ি থেকে ছড়িয়ে পড়ছে তামাম মহল্লায়। এ বার ডেঙ্গির সংক্রমণ কেন এত ব্যাপক ও দ্রুত, তার উত্তর খুঁজতে গিয়ে বেরিয়ে আসছে এই তথ্য। কিছু বিশেষজ্ঞ বলছেন, ডেঙ্গির এ হেন বাড়বাড়ন্তের পিছনে ডেঙ্গি-ভাইরাসের বিরুদ্ধে মানবশরীরের ‘অসহায়তা।’ কেউ আঙুল তুলেছেন ডেঙ্গিবাহক এডিস ইজিপ্টাই মশার স্বভাবকে। ওই বিশেষজ্ঞদেরই অনেকে আবার ডেঙ্গির বাড়বাড়ন্তের পিছনে দু’টো কারণেরই মিলিত প্রতিক্রিয়া দেখছেন।
বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, ডেঙ্গির অতি-সংক্রমণের জন্য দায়ী জীবাণুবাহক মশা এডিস ইজিপ্টাইয়ের ‘মরিয়া’ স্বভাব। তার খিদের তাড়না এমনই যে, এক জনকে কামড়ে তৃপ্তি আসে না, অন্তত দশ জনের শরীর থেকে রক্ত টানতে হয়। দিল্লির গঙ্গারাম হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সৌরেন পাঁজার কথায়, “একটি স্ত্রী ইজিপ্টাই পেট ভরাতে অন্তত দশ জনকে কামড়ায়। যদি সে ডেঙ্গির জীবাণুবাহক হয়, তা হলে সকলের মধ্যে ওই জীবাণু ঢুকবে। এক-একটা এডিস মশা তার জীবৎকালে অন্তত তিরিশ-চল্লিশ বার মানুষকে কামড়ায়। প্রতিটা কামড়ে তাই ডেঙ্গি সংক্রমণের আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে।”
অর্থাৎ এডিস ইজিপ্টাইয়ের এ হেন ‘চরিত্রদোষেই’ ডেঙ্গি দ্রুত ছড়াচ্ছে বলে সৌরেনবাবুর দাবি। কিন্তু এর স্বভাব তো বরারবরই এমন! তা হলে এ বারই রোগের দাপট এত প্রবল কেন? |
ইজিপ্টাইয়ের ইতিবৃত্ত |
বৈজ্ঞানিক নাম: এডিস ইজিপ্টাই |
আয়ু: এক মাস |
খাদ্য: গাছের পাতার রস |
বংশবিস্তার: অনুকূল সময় বর্ষাকাল |
ডিম পাড়ে: ৬ থেকে ৭ বার। পরিষ্কার ও অল্প জলে |
রক্ত লাগে: স্ত্রী মশার, ডিম বড় করতে |
প্রতি বার ‘খিদে’ মেটাতে কামড়ায়: অন্তত দশ জনকে |
ডেঙ্গির ভাইরাস থাকে: শুঁড়ে, সেখানেই বংশবৃদ্ধি। ফলে মশার শরীরে এক বার ডেঙ্গির ভাইরাস প্রবেশ করলে মশা না মরা পর্যন্ত সেখানেই থেকে যায়। মশা যাকে কামড়ায়, তারই শরীরে প্রবেশ করে ওই রোগ-জীবাণু। |
|
বিশেষজ্ঞদের একাংশের ব্যাখ্যা: আগে এডিস ইজিপ্টাইয়ের বংশবৃদ্ধি কোনও কারণে কম ছিল, যা এ বার পরিবেশগত ও অন্য বিভিন্ন কারণে অনেকটা বেড়ে গিয়েছে। অন্য দিকে তখন পরিবেশে ডেঙ্গি ভাইরাসের রমরমাও এতটা ছিল না। এ প্রসঙ্গে মানবশরীরে প্রতিরোধশক্তির বিষয়টিও উঠে আসছে। কলকাতার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ কলেরা অ্যান্ড এন্টেরিক ডিজিজ (নাইসেড)-এর অধিকর্তা, ভাইরোলজিস্ট শেখর চক্রবর্তীর অনুমান, এ মরসুমে যে ধরনের ডেঙ্গি-জীবাণুর সংক্রমণ ঘটেছে, তার বিরুদ্ধে মানবশরীরে প্রতিরোধক্ষমতা গড়ে ওঠেনি। তাই যাঁরই দেহে জীবাণু ঢুকছে, তিনিই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।
উল্লেখ্য, ডেঙ্গির ভাইরাস চার রকম ডেং-১, ডেং-২, ডেং-৩ এবং ডেং-৪। শেখরবাবু বলেন, “২০০৫-এ কলকাতায় ডেং-৩ ভাইরাস সংক্রমণ হয়েছিল। ২০০৮-০৯ সালে আর ডেং-৩ পাওয়া যায়নি, সে বার ছিল ডেং-১, ২ আর ৪। মনে হয়, এই তিন ভাইরাসের বিরুদ্ধে এখনও আমাদের শরীরে প্রতিরোধক্ষমতা তৈরি হয়নি।”
মহানগরে ডেঙ্গির দাপটের পিছনে দু’টো কারণই কাজ করছে বলে মনে করছেন অনেকে। পরিত্রাণের উপায় কী?
ডেঙ্গি-মশার ‘স্বভাব’ থেকে শিক্ষা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন সৌরেনবাবু। তাঁর মন্তব্য, “বাড়িতে এক জন ডেঙ্গি-রোগী থাকলে তাঁকে মশারির ভিতরে রাখতে হবে। কারণ, তাঁর রক্ত থেকে জীবাণু নিয়েএকটা ইজিপ্টাই মশা আরও ন’জনের মধ্যে রোগ ছড়িয়ে দিতে পারে।” ওই চিকিৎসক এ-ও জানাচ্ছেন, সাধারণ ডেঙ্গি হলে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার দরকার নেই। তবে প্লেটলেট খুব নেমে গেলে, শরীরে জল কমে গেলে, খেতে না-পারলে কিংবা শরীরের কোনও অংশ থেকে রক্তক্ষরণ শুরু হলে হাসপাতালে ভর্তি হতেই হবে।
দশ বছর ধরে দিল্লিতে ডেঙ্গি-রোগী সামলেছেন সৌরেনবাবু। এখন তিনি কলকাতায়, বাইপাসের এক বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গি-রোগীদের চিকিৎসা ও পরামর্শ দিচ্ছেন। বস্তুত ডেঙ্গির উপসর্গ থাকলেই কলকাতায় মানুষ যে ভাবে আতঙ্কিত হয়ে পড়ছেন, তা দেখে তিনি যারপরনাই বিস্মিত। ওঁর দাবি: কলকাতায় তাঁর দেখা রোগীদের বড়জোর ৫-৭ শতাংশের বাড়াবাড়ি ধরনের সংক্রমণ হয়েছে। ‘শক সিন্ড্রোম’-এর শিকার খুব কমই। তলপেটে ব্যথা, ডায়েরিয়া, বমি ইত্যাদি লক্ষণযুক্ত ডেঙ্গি-রোগী অবশ্য পেয়েছেন। আবার অনেকের উপসর্গ ফ্যালসিপেরাম ম্যালেরিয়ার উপসর্গের সঙ্গে মিলে গিয়েছে, যাঁদের ক্ষেত্রে বিশেষ নজরদারি জরুরি। এ সত্ত্বেও ডেঙ্গিতে যে অযথা আতঙ্ক ছড়ানোর কারণ নেই, তা বোঝাতে সৌরেনবাবু বলেন, “দিল্লিতে আমার নিজেরই এক বার ডেঙ্গি হয়েছিল। প্লেটলেট কাউন্ট নেমে গিয়েছিল ৩৯ হাজারে। কিন্তু হাসপাতালে ভর্তি হইনি।”
তবে গত দু’দিনের বৃষ্টি ডেঙ্গির দৌরাত্ম্যকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনবে বলে পতঙ্গবিদদের আশা। ভাইরোলজিস্টরাও মনে করছেন, ডেঙ্গির এই সংক্রমণ সাময়িক। তাঁদের বক্তব্য, মানবশরীরে এক বার জীবাণুর প্রতিরোধক্ষমতা তৈরি হয়ে গেলে ভয় নেই। এক বার যাঁর ডেঙ্গি হয়ে গিয়েছে, তাঁকে পরের বার ডেঙ্গিবাহী মশা কামড়ালেও প্রতিক্রিয়া হবে নগণ্য। সৌরেনবাবুরও আশ্বাস, রোগের প্রকোপ বেশি দিন স্থায়ী হবে না। “দিল্লিতে দেখেছি, বর্ষার আগেই প্রশাসন প্রচারে নামে। ওখানে স্কুলপাঠ্যেও স্বাস্থ্য-সচেতনতার বিষয়গুলো ঢোকানোর চিন্তাভাবনা চলছে। সচেতনতা এমন পর্যায়ে পৌঁছালে কলকাতায় ডেঙ্গি-ম্যালেরিয়া নিয়ে এত আতঙ্ক থাকবে না।” আশা প্রকাশ করেন দিল্লি প্রবাসী ওই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। |