বড়দের জাত নিয়ে বাছবিচারের জেরে বন্ধ শিশুদের পুষ্টিকর খাবার দেওয়ার সরকারি প্রকল্প। রঘুনাথপুর ২ ব্লকের লালডাঙা অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের ঘটনা। সেখানকার অঙ্গনওয়াড়ি সহায়িকা অথাৎ রাঁধুনি ‘নিচু জাতের’- এই অপবাদ দিয়ে বাসিন্দাদের একাংশ তাঁর হাতে রান্না খাবার শিশুদের খেতে দিতে দিচ্ছেন না। খাবার নেওয়া বন্ধ করেছেন প্রসূতিরাও। ফলে ওই এলাকায় অঙ্গনওয়াড়ি প্রকল্পের কাজ ব্যাহত হচ্ছে।
পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রশাসনের আধিকারিকেরা এখন ওই সহায়িকার রান্না করার খাবার সবাই মিলে খেয়ে গ্রামবাসীদের ‘ভুল’ ধারণা ভাঙার চিন্তা ভাবনা করেছেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, নিলডি পঞ্চায়েতের মল্লিকপাড়া গ্রামের একটি ক্লাব ঘরে ওই অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র চলত। স্থানীয় ভাবে ঠিক করা এক মহিলা খাবার রান্না করতেন। সে সময় শিশু ও প্রসূতি মিলিয়ে দৈনিক প্রায় ৬০ জন খাবার খেত। বছর দু’য়েক আগে ওই গ্রামেরই এক প্রান্তে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের নতুন ভবন তৈরি হয়। অঙ্গনওয়াড়ি সহায়িকা হিসেবে সেখানে নিয়োগ করা হয় রঘুনাথপুর ১ ব্লকের গোবিন্দপুর গ্রামের বাসিন্দা সন্ধ্যা রইদাসকে। তাঁর অভিযোগ, কাজে যোগ দেওয়ার পরেই গ্রামের কয়েকজন তাঁর জাত কী তা জানতে চেয়েছিলেন। তাঁরা সন্ধ্যাদেবীকে নীচু জাতের বলে উল্লেখ করে শিশুদের খাবার রান্না করতে নিষেধ করেছিলেন।
সম্প্রতি ডিভিসির নির্মীয়মান বিদ্যুৎকেন্দ্র লাগোয়া মল্লিকপাড়া গ্রামের ওই অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেল, ৫-৬টি শিশুকে পড়াচ্ছেন অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী চৈতালি মণ্ডল। তাঁরা জানান, খাবার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শিশুরা এখানে আসার উৎসাহ হারিয়েছে। প্রসূতিরাও গত দু’বছরে এখানে খাবার নিতে আসেননি। ফলে এই প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ পুষ্টিকর খাবার দেওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
সন্ধ্যাদেবী.বলেন, “প্রতিদিনই হাতে গোনা কয়েকটি শিশু এখানে আসে। পড়াশোনা শেষে ওরা বাড়ি চলে যায়। সামাজিক ভাবে অস্পৃশ্যতার শিকার হয়ে খুব খারাপ লাগে। বাচ্চাগুলো শুকনো মুখে ফিরে যায়। আমার রান্না করাই কাজ। কিন্তু তাও করতে পারি না। গ্রামের লোকেরা জানিয়ে দিয়েছেন, আমি নিচুজাত হওয়াতে আমার হাতের রান্না করা খাবার কেউ খাবে না।” তিনি জানান, কাজে যোগ দেওয়ার পরে কয়েকবার গ্রামবাসীদের বিরুদ্ধে গিয়ে তিনি রান্না করেছিলেন। কিন্তু খাবার শেষ পর্যন্ত ফেলে দিতে হয়েছে। তার পরে আর রান্না করাননি চৈতালিদেবী। তিনি বলেন, “গ্রামবাসীদের বহু বোঝানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু ওরা শুনতে নারাজ। কেউ সন্ধ্যাদির হাতের রান্না খেতে রাজি নয়। তাই বাধ্য হয়ে রান্না বন্ধ করতে হয়েছে।” তাঁর আক্ষেপ, একাধিকবার প্রশাসনের বিভিন্ন আধিকারিককে জানানো হয়েছে। কিন্তু সন্ধ্যাদেবীর তৈরি করা খাবার খেতে শিশু ও প্রসূতিরা আসেননি।
গ্রামে গিয়েও বোঝা গেল স্রেফ নিচুজাতের হাতে রান্না করা খাবার খাবে না বলেই সেখানে রান্না করা বন্ধ করে দিয়েছেন গ্রামবাসীরা। কোনওরকম রাখঢাক না করেই বাসিন্দা রাজু মল্লিক, বতিরাম মল্লিক, গৃহবধু পূর্ণিমা মল্লিকরা দাবি করেন, “অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের সহায়িকা নিচু জাতের। তাই তাঁর রান্না করা খাবার খাওয়া যাবে না।” এই গ্রামে প্রায় ৬০টি পরিবারের বাস। বস্তুত এ গ্রামের বাসিন্দারা ভাগচাষ করে বা দিনমজুরির কাজ করে দিন গুজরান করেন। আর্থিক ভাবে যথেষ্ট অস্বচ্ছল। ফলে প্রসূতি বা শিশুদের সুষম খাদ্য দেওয়ার সঙ্গতির যথেষ্ট অভাব রয়েছে। তাই শুধু উঁচু জাতের দোহাই দিয়ে তাঁরা আদতে শিশু ও প্রসূতিদের সুষম খাদ্য খেতে বঞ্চিত করছেন বলে প্রশাসনের একাংশ জানিয়েছেন। গ্রামের মাতব্বর বলে পরিচিত ছোটু মল্লিক বলেন, “সন্ধ্যা রুইদাসকে এখান থেকে বদলি করে দিলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। এটা কেউ বুঝতে পারছে না কেন?”.
এই এলাকার পঞ্চায়েত সদস্য তথা স্থানীয় নীলডি পঞ্চায়েতের প্রধান সিপিএমের ঠাকুরদাস রজকের কথায়, “গ্রামবাসীদের বহু বোঝানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু জাতপাতের শিকড় ওদের মনের এত গভীরে ঢুকে রয়েছে, যে চেষ্টা করেও শিকড় তুলে ফেলা যাচ্ছে না।” এই পরিস্থিতির মধ্যে সন্ধ্যাদেবীকে সম্প্রতি অন্যত্র বদলি করার চেষ্টা করে প্রশাসনের একাংশ। তা জানতে পেরেই রদ করে দেন বিডিও। বিডিও উৎপল ঘোষ বলেন, “জাত পাত নিয়ে সমস্যার জন্য ওই কর্মীকে বদলি করে দেওয়ার অর্থই হল প্রশাসনের পিছিয়ে যাওয়া। এটা করা যাবে না। পরিবর্তে আমরা অন্য ভাবে সমস্যা মেটানোর চেষ্টা করছি।” বিডিও জানান, “প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিয়ে বা পুলিশ দিয়ে জোর করে এই সমস্যার সমাধান করা যাবে না। একমাত্র উপায় গ্রামবাসীদের সচেতন করা। সব রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি, পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতির সদস্যদের নিয়ে ওই গ্রামে গিয়ে আমরা অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের ওই সহয়িকার হাতে রান্না করা খাবার খাব বলে ঠিক করেছি। গ্রামবাসীদের আমরা সঙ্গে ডেকে নেব।” সুসংহত শিশু বিকাশ প্রকল্পের জেলা আধিকারিক স্বপন মুখোপাধ্যায় বলেন, “ওই কর্মীকে বদলি করা সমস্যার সমাধান নয়। বরং সমস্যা থেকে পালিয়ে যাওয়া। গ্রামবাসীদের বুঝিয়ে রাজি করানোর কাজটাই এখন করতে হবে।” |