চার বছর আগে স্ট্রোকে যখন ডান হাত-ডান পা অচল হয়ে যায়, তখন এক লহমার জন্য মনে হয়েছিল, জীবনটা শেষ হয়ে গেল!
আর ২০১২-র শিক্ষক দিবসে সেই তাঁকেই যখন পড়ুয়ারা হাত ধরে স্কুলে নিয়ে যাচ্ছে, তখন তাঁর মনে হচ্ছিল, এটাই তো জীবন! অবসরের পরেও রোজ সকালে ভ্যানরিকশা ভাড়া করে এক কিলোমিটার দূরের প্রাথমিক স্কুলে গিয়ে ছাত্রছাত্রীদের পড়ানোটাই আনন্দ ষাটোর্ধ্ব জগন্নাথ কর্মকারের। বাঁ হাতে ব্ল্যাকবোর্ডে লেখেন, বই ধরে পড়ান। সামনে সার দিয়ে পড়ুয়ারা। জগন্নাথবাবুর কথায়, “এর চেয়ে আনন্দ আর কিছুতে পাই না।”
আসলে ওষুধের থেকেও এই কচিমুখগুলোই বেশি সুস্থ রাখে পুরুলিয়ার মানবাজারের সিন্দুরপুর গ্রামের বাসিন্দা জগন্নাথবাবুকে। যিনি এলাকায় ‘বড় মাস্টার’ বলেই বেশি পরিচিত। সকাল ৯টার মধ্যে ভ্যানরিকশায় চেপে গোপালনগর পুরাতন প্রাথমিক স্কুলে পৌঁছে যান তিনি। তার পর থেকেই বিরামহীন কাজ। স্কুলচত্বর ঝাঁট দেওয়ানো থেকে শুরু করে পড়ুয়াদের দিয়ে প্রার্থনা করানো, মিড-ডে মিল দেখার কাজকী নেই সেই তালিকায়! যত্ন নিয়ে ছাত্রদের পড়াতে ভুল হয় না কখনও। |
জগন্নাথবাবু বললেন, “২০০৮-এর এপ্রিলে স্কুলেই হঠাৎ স্ট্রোক হল। ডান হাত-পা অচল হয়ে গেল। দু’-আড়াই মাস লাগে বাঁ হাতে লেখা রপ্ত করতে। কিন্তু সেপ্টেম্বরে অবসরের পরে বাড়িতে মন বসছিল না। মনে হচ্ছিল, আরও অসুস্থ হয়ে পড়ছি। তাই ফের স্কুলে আসা শুরু করি। এখানে এলে মনেই হয় না, আমার কোনও অসুখ আছে!”
শিক্ষক দিবসে জগন্নাথবাবু ভ্যানরিকশায় স্কুলের সামনে নামলেন। হাত ধরে পড়ুয়ারাই নিয়ে গেল ভিতরে। সহকর্মী ও গ্রামবাসীরা শুভেচ্ছা জানালেন। মিষ্টিমুখও হল। তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র রঞ্জন বাউরি, চতুর্থ শ্রেণির শচীন কর্মকার, আলতাফ আনসারিরা বলল, “বড় মাস্টার খুব সহজে পড়া বোঝান। না বুঝলে বারবার বোঝান।”
স্কুলের টিচার-ইন-চার্জ সামসুদ্দিন আনসারি বলেন, “স্কুলে প্রায় ২০০ পড়ুয়া। চার জন মাত্র শিক্ষক। তাই জগন্নাথবাবু স্কুলে আসায় আমরা অনেক ভরসা পেয়েছি।” স্থানীয় গ্রাম শিক্ষা কমিটির সভাপতি তথা গোপালনগর পঞ্চায়েতের সদস্য সুধাকর কর্মকার বলেন, “২৬ বছর আগে জগন্নাথবাবু যখন প্রথম এখানে আসেন, তখন স্কুলে ৫ জন ছাত্র। উনিই বাড়ি বাড়ি ঘুরে ছেলেমেয়েদের স্কুলে টেনে আনতেন। এখনও স্কুলকে আগলে রাখেন।”
অবসরের দিনে বাসিন্দারা বলেছিলেন, “থেকে যান।” টান এড়াতে পারেননি জগন্নাথবাবু। বড় ছেলে উমাপদ কর্মকারের কথায়, “বাবাকে বলেছি, বিশ্রাম নাও। বাবা কথা কানে তোলেনি। ছাত্ররাই বাবার প্রাণ।” পুরুলিয়া জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের সভাপতি নীলকমল মাহাতো বলেন, “আমরা সরকারি ভাবে জগন্নাথবাবুকে স্কুলে পড়ানোর অনুমতি দিতে পারি না। তবে উনি প্রকৃত ছাত্রদরদী শিক্ষক। তাই স্কুলের টান এড়াতে পারেননি।”
বাঁ হাতে খসখস করে লিখে চলেন বৃদ্ধ। ব্ল্যাকবোর্ডে ছায়া পড়ে বনস্পতির। |