জমি পাওয়া নিয়ে সমস্যা হচ্ছে। ফলে রাজ্য সরকারের ‘নিজ গৃহ, নিজ ভূমি’ প্রকল্পে গরিবদের জন্য বাড়ি তৈরির ক্ষেত্রে উত্তর ২৪ পরগনায় সমস্যার মুখে পড়েছে জেলা প্রশাসন।
বনগাঁ মহকুমার বাগদা ব্লকের সাগরপুর গ্রামের এক বাসিন্দা ব্লক প্রসাসনেক কাছে লিখিতভাবে জানিয়েছিলেন, তিনি তাঁর জমি সরকারি প্রকল্পের জন্য বিক্রি করতে চান। ওই এলাকায় প্রতি বিঘা জমির দাম ৪ থেকে সাড়ে ৪ লক্ষ টাকা। ওই ব্যক্তির কাছ থেকে সাড়া পেয়ে ‘নিজ গৃহ, নিজ ভূমি’ প্রকল্পে জমি কিনতে উদ্যোগী হয় ব্লক প্রশাসন। কিন্তু কিছুদিন পরে ওই ব্যক্তি বিডিও দফতরে হাজির হয়ে বিডিও খোকনচন্দ্র বালাকে জানান, বিঘা প্রতি ১০ লক্ষ টাকা দাম না পেলে তিনি জমি বিক্রি করবেন না। দামের জন্য এর পর আর ওই জমি কেনা সম্ভব হয়নি ব্লক প্রশাসনের পক্ষে।
লিখিত সম্মতি দেওয়ার পরেও কেন ওই ব্যক্তি জমি দিতে রাজি হলেন না? খোকনবাবু বলেন, “আমরা খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি, ওই ব্যক্তি ‘নিজ গৃহ, নিজ ভূমি’ প্রকল্পের জন্য প্রশাসনের কাছে যাত জমি বিক্রি না করেন সেজন্য স্থানীয় কয়েকজন তাঁর উপরে চাপ সৃষ্টি করেছিল। এমনকী কেউ কেউ তাঁকে এমন প্রতিশ্রুতি দেন যে, ওই জমি তাঁরা বিঘাপ্রতি ১০ লক্ষ টাকা দিয়ে কিনে নেবেন।”
এমনটা ঘটার কারণ কি?
ব্লক প্রশাসন সূত্রে খবর, এই প্রকল্পে জমি কিনে দিয়ে বা খাস জমিতে মূলত গরিবদের জন্য বাড়ি তৈরি করা হচ্ছে। স্বাভাবিক ভাবে শিক্ষাদীক্ষায়, সংস্কৃতিতে তাঁরা সামাজিক ভাবে পিছিয়ে। এই অবস্থায় তথাকথিত উন্নত এলাকার মানুষ তাঁদের এলাকায় এই সব গরিব মানুষদের বসবাস করাটা এনেক ক্ষেত্রেই মেনে নিতে পারছেন না। এটা একটা সামাজিক সমস্যা। ফলে যিনি জমি বিক্রি করতে চান, তাঁর উপরে স্থানীয় ভাবে চাপ তৈরি করা হচ্ছে বা তাঁকে নানা ভাবে বিব্রত করা হচ্ছে। তাঁদের আশঙ্কা গরিবরা তাঁদের এলাকায় বসবাস শুরু করলে পরিবেশ নষ্ট হতে পারে। দেখা দেবে নানা সামাজিক সমস্যাও।
শুধু এ ধরনের সমস্যাই নয়, গোটা উত্তর ২৪ পরগনায় ‘নিজ গৃহ, নিজ ভূমি’ প্রকল্পের কাজে নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে জেলা প্রশাসনকে। অবস্থা এমনই যে, এখন পর্যন্ত জেলার ২২টি ব্লকের মধ্যে শুধুমাত্র বাগদা ব্লকে এই প্রকল্পে গৃহহীনরা জমির পাট্টা এবং ঘর পেয়েছেন। বাগদা ব্লক প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়ছে, মামাভাগ্নে এলাকায় তিন একর ৩৮ শতক জমি কিনে সেখানে ৭৫টি ভূমি ও গৃহহীন পরিবারকে ঘর তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। সেখানে রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। পানীয় জল, শৌচাগার, বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, স্বনির্ভর হওয়ার জন্য ওই সব পরিবারের মধ্যে ফলের চারাও বিতরণ করা হয়েছে। স্বনির্ভর গোষ্ঠী তৈরি করে সেখানকার মহিলাদের স্কুলে রান্নার কাজ দেওয়া হয়েছে। গোটা রাজ্যে এই প্রকল্পের জন্য বাগদাকে মডেল হিসাবে দেখছেন রাজ্য প্রশাসনের কর্তারা। অতিরিক্ত জেলাশাসক (ভূমি ও ভূমি সংস্কার) সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় বলেন, “জেলার ২২টি ব্লকের মধ্যে বাগদা ব্লকেই ‘নিজ গৃহ, নিজ ভূমি’ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। আরও পাঁচটি ব্লকে এ জন্য ১০ একর জমি তৈরি আছে। চলতি মাসেই মুখ্যমন্ত্রীর জেলায় আসার কথা। তিনি এসে প্রাপকদের হাতে জমির পাট্টা তুলে দেবেন।” জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, যে সমস্ত ব্লকে ওই ১০ একর জমির পাট্টা দেওয়া হবে সেগুলি হল বারাসত-১, বসিরহাট-১, মিনাখাঁ, হাসনাবাদ এবং স্বরূপনগর।
কিন্তু জেলায় এই প্রকল্প গতি না পাওয়ার কারণ?
জেলা প্রশাসন সূত্রের খবর, জেলায় নিজস্ব ভূমি বা ঘরবাড়ি নেই এমন পরিবারের সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার। তৃণমূল স্তরে সমীক্ষা চালিয়ে এই রিপোর্ট তৈরি করেছেন আর আই (রেভিনিউ ইন্সপেক্টর)। সমীক্ষায় যে সমস্যাগুলি উঠে এসেছে তা হল----
১) যে পরিবারগুলিকে পাওয়া যাচ্ছে তাঁদের অনেকে বিপিএল তালিকাভুক্ত নন। সমস্যা হল বিপিএল তালিকাভুক্ত না হলেও জমির পাট্টা দেওয়া যায়। কিন্তু ঘর তৈরির টাকা দেওয়া যায় না। সরকারি বিভিন্ন প্রকল্প যেমন, ‘ইন্দিরা আবাস যোজনা’, ‘গীতাঞ্জলি’ এবং ‘আমার ঠিকানা’-য় ঘর তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বিপিএল তালিকাভুক্ত না হওয়ায় অনেকে এই সুবিধা পাচ্ছেনা না। আবার ‘গীতাঞ্জলি’ শুধুমাত্র সংখ্যালঘুদের জন্য।
২) জেলায় খাস জমির পরিমাণ কমে গিয়েছে।
৩) জমি কিনে দেওয়ার ক্ষেত্রে মূল সমস্যা হল, জমির মালিক সরকারি নির্ধারিত দামের তুলনায় অনেক বেশি টাকা দাবি করছেন।
৪) তালিকায় থাকা বহু পরিবারের সদস্যদের সচিত্র পরিচয়পত্র নেই। ফলে এ দেশের নাগরিক হিসাবে প্রমাণ করার ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দিচ্ছে। কারণ, জেলায় বহু বাংলাদেশি বেআইনিভাবে বাস করছেন।
৫) বাড়ি তৈরির জন্য একটি পরিবারকে ৪৫ হাজার এবং শৌচাগার তৈরির জন্য ১০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, এই টাকায় তাঁরা শুধু বাড়ির ভিত তৈরি করেছেন, বাড়ি আর তৈরি হয়নি।
৬) গরিব মানুষ সাধারণ রাস্তার ধারে ঝুপড়িতে বাস করেন। তাই বেশ কিছু দূরে গ্রামের ভিতরে গিয়ে বসবাস করতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।
এই সব সমস্যা মেটাতে গত ৪ সেপ্টেম্বর ডিরেক্টর ল্যান্ড রেকর্ডস অ্যান্ড সার্ভে, জেলাশাসক, অতিরিক্ত জেলাশাসক (ভুমি ও ভূমি সংস্কার), বিডিও, বিএলআরও এবং মহকুমাশাসকের উপস্থিতিতে এক বৈঠক হয়। হাজির ছিলেন ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পের কমিশনার, পঞ্চায়েত সচিব প্রমুখ। |