অসমের রানি, হরিয়ানার তিনজোড় এবং পশ্চিমবঙ্গের রাজাভাতখাওয়া, দেশের বিভিন্ন প্রান্তের এই তিনটি জায়গায় আসলে এক সুতোয় গাঁথা। এই তিনটি জায়গাতেই রয়েছে ‘শকুন সংরক্ষণ এবং প্রজনন কেন্দ্র’। এ বার রানি, তিনজোড়, রাজাভাতখাওয়ার সঙ্গে উচ্চারিত হতে চলেছে ত্রিপুরার সিপাহিজলা অভয়ারণ্যের নামও।
কেন্দ্রের আর্থিক সহায়তায় সিপাহিজলায় গড়ে উঠতে চলেছে ‘শকুন সংরক্ষণ এবং প্রজনন কেন্দ্র’। সিপাহিজলা অভয়ারণ্যের অধিকর্তা অজিত ভৌমিক জানিয়েছেন, এই কেন্দ্র গড়ার জন্য ইতিমধ্যেই কেন্দ্রের কাছে প্রকল্প-প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। প্রয়োজনীয় অনুমোদন পেলেই কাজ শুরু করা হবে।
রাজ্যে শকুনের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য ভাবে কমে যাওয়ায় ত্রিপুরা বন দফতরও ২০০৮ সালে একটি টেকনিক্যাল কমিটি তৈরি করে। সমস্ত দিক পর্যালোচনা করে কমিটি একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে সমীক্ষার দায়িত্ব দেয়। ২০০৯ সালে সেই সমীক্ষা রিপোর্টটি জমাও পড়ে। সমীক্ষায় জানা যায়, রাজ্যে শকুনের সংখ্যা মাত্রাতিরিক্ত ভাবে কমেছে। ২০০৯ সালে সংখ্যাটি ছিল ৫৫। তাতেই রাজ্যের বন দফতর নড়েচড়ে বসে। কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে শকুন সংরক্ষণের জন্য আর্থিক সাহায্যের আবেদন জানানো হয়। দ্রুত অবলুপ্তির পথে যাওয়া বিশালাকার প্রাণীটির প্রজনন এবং সংরক্ষণের জন্য রাজ্যেও একটি কেন্দ্র গড়ে তোলার পরিকল্পনার শুরু তখনই। প্রজনন এবং সংরক্ষণ কেন্দ্রে জন্মানো নতুন শকুনগুলিকে বড় করে সারা রাজ্যের বিভিন্ন অভয়ারণ্যে ছেড়ে দেওয়া হবে। |
উল্লেখ্য, শকুন নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের ‘ন্যাশনাল অ্যাকশন প্ল্যান’-এর অঙ্গ হিসেবেই মুম্বইয়ের ‘বম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটি’-র কারিগরি সহায়তা এবং কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক সাহায্যে হরিয়ানার তিনজোড়ে শকুন প্রজনন ও সংরক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়। তারপর একে একে আরও দু’টি। এই কেন্দ্রগুলিতে ‘সাফল্য’ এসেছে বলে অজিতবাবু জানান। ২০১৪ সাল নাগাদ এই প্রজনন কেন্দ্রগুলিতে জন্মানো পরিণত শকুনগুলিকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ‘সংরক্ষিত বনাঞ্চলে’ ছেড়ে দেওয়ার পরিকল্পনা চলছে। এ ছাড়াও ওড়িশার নন্দনকানন, হায়দরাবাদ, আমদাবাদ, ভোপাল এবং রাঁচি চিড়িয়াখানাতেও শকুন প্রজনন এবং সংরক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয় সরকার নিয়েছে।
উল্লেখ্য, এ বছরের প্রথম দিকে দিল্লিতে সার্কগোষ্ঠীভুক্ত দেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে ‘শকুন গবেষণা, সংরক্ষণ ও সচেতনা’ বিষয়ে একটি আলোচনাচক্রে উঠে এসেছে কিছু ‘প্রাসঙ্গিক’ তথ্যও। কেন সারা পৃথিবীতে এই ‘বিশালাকায় অদ্ভুত প্রকৃতি’-র পাখিটি অবলুপ্তির পথে? অজিতবাবু জানান, প্রাণী এবং পরিবেশ বিজ্ঞানীদের একাংশের অভিমত: গৃহপালিত প্রাণীর চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত ‘ডিক্লোফেনাক্’ নামে একটি ওষুধের ব্যাপক ব্যবহার, শকুনের সংখ্যা কমার অন্যতম বড় কারণ। এ ধরনের গৃহপালিত পশুর দেহাবশেষ শকুনের পক্ষে খুবই ক্ষতিকর। বর্তমানে প্রাণী-চিকিৎসকদেরও এই বিষয়ে সচেতন করা হচ্ছে। এ জাতীয় ওষুধ যাতে যথেচ্ছ ব্যবহার না করা হয় তার উপর জোর দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়াও লোকালয়ে বড় বড় গাছ, যেমন-- বট, অশ্বথ্ব, শিমুল ইত্যাদি ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছে ‘উন্নয়নে’-র কারণে। ফলে শকুনের বাসস্থানের সংকট দেখা দিচ্ছে। তাদের প্রজননের অসুবিধা হচ্ছে। এখন প্রাণিজগতের শৃঙ্খলা এবং পরিবেশ ভারসাম্যে শকুনের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করছে সবাই। এউ কারণেই ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল প্রভৃতি সার্কভুক্ত দেশগুলি শকুনদের জন্য একটি ‘নিরাপদ অঞ্চল’ (সেফ জোন) তৈরির কথা নীতিগত ভাবে মেনেও নিয়েছে। |