শিক্ষক দিবসে শিক্ষক-বরণের জন্য চলছিল তোড়জোড়। বেলুন, রঙিন শিকলি দিয়ে ক্লাসঘর সাজাচ্ছিল চতুর্থ শ্রেণির কচিকাঁচারা। হচ্ছিল হইচই। সেই ‘অপরাধে’ সাতটি বাচ্চাকে ধাতব ‘ক্যান’ দিয়ে ‘পেটালেন’ শিক্ষক। মাথা ফাটল চার জনের।
বুধবার ব্যান্ডেলের একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ঘটনা। ছাত্রদের মারধরের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে ওই স্কুলের ভাইস-প্রিন্সিপ্যাল সুবীর মণ্ডলকে। ঘটনার প্রতিবাদে এ দিন প্রথমে স্কুলে, পরে থানায় বিক্ষোভ দেখান অভিভাবকেরা। পুলিশ স্কুলে গিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়। সুবীরবাবুর বিরুদ্ধে এর আগেও ছাত্রদের উপরে নির্যাতন চালানোর অভিযোগে সরব হন অভিভাবকেরা। |
পুলিশ ও স্কুল সূত্রের খবর, সাড়ে ৮টায় ক্লাস শুরু হয়। শিক্ষক দিবস উপলক্ষে সাড়ে ১২টায় ছুটির কথা ঘোষণা করেছিলেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। ঠিক হয়েছিল, ক্লাসে ক্লাসে প্রথমে শিক্ষক বরণের অনুষ্ঠান হবে। সেই মতো সকাল ৯টা নাগাদ চতুর্থ শ্রেণির ‘এ’ সেকশনের ছাত্রেরা নিজেদের ক্লাসরুম সাজাচ্ছিল। ছাত্রদের একাংশ ‘ফোম-ক্যান’ নিয়ে নিজেদের মধ্যে হইচই করছিল। সেই সময়ে ক্লাসে আসেন সুবীরবাবু। ছাত্রদের হইচই করতে দেখে তিনি রেগে যান। কাউকে কিছু বলতে না দিয়ে তিনি এক ছাত্রের হাত থেকে ওই ‘ফোম-ক্যান’ কেড়ে নেন। সকলকে মাথা নিচু করে দাঁড় করিয়ে দেন। প্রথমেই সুবীরবাবু ‘মনিটর’ ঈশান দাসের মাথায় ওই ‘ক্যান’ দিয়ে মারেন বলে অভিযোগ। ঈশানের মাথা ফেটে রক্ত ঝরতে থাকে। সে কেঁদে ফেলে। তার পরেও সুবীরবাবু একই ভাবে অরিত্র দাশগুপ্ত, কৌশিক হরিজন, আকাশ মোদক, সাগ্নি ঘোষ, সাগ্নিক রুদ্র এবং শুভদীপ পাল নামে ছয় পড়ুয়াকে মারেন বলে অভিযোগ। মাথা ফাটে অরিত্র, কৌশিক এবং আকাশেরও।
ছাত্রদের চেঁচামেচিতে স্কুলের অন্য শিক্ষকেরা চলে আসেন। তাঁরা আহতদের নার্সিংহোমে নিয়ে যান। ঈশানের মাথায় ৬টি এবং অরিত্রের মাথায় ৩টি সেলাই পড়ে। বাকিদের কেউ বমি করে ফেলে, কারও মাথার যন্ত্রণা শুরু হয়ে যায়। স্কুলের তরফে আহতদের বাড়িতে খবর দেওয়া হয়। স্কুলে এসে ঘটনার কথা শুনে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন অভিভাবকেরা। ঘটনার জেরে এর পরে স্কুলের অন্যান্য ক্লাসের অনুষ্ঠান বাতিল হয়ে যায়। ঈশানের বাবা কৌশিক দাস বলেন, “ছেলে অন্যায় করে থাকলে শাস্তি নিশ্চয়ই দেওয়া যেত। কিন্তু এমন ভাবে মারার প্রয়োজন ছিল কি?”
সুবীরবাবুর বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করেন অভিভাবকেরা। স্কুলেই গ্রেফতার হন সুবীরবাবু। এই ঘটনা নিয়ে ‘ফাদার’ কে ভি ম্যাথিউ কোনও মন্তব্য করতে চাননি। তিনি বলেন, “এখন কিছু বলা যাবে না।” তবে শিক্ষক চম্পক মণ্ডল বলেন, “দুঃখজনক ঘটনা। সুবীরবাবু যে কেন ওই রকম শাস্তি দিতে গেলেন, বুঝতে পারছি না।” অভিভাবকদের অভিযোগ, মাঝেমধ্যেই নানা কারণে সুবীরবাবু ছাত্রদের উপরে ‘নির্যাতন’ চালান। |
জুভেনাইল জাস্টিস বোর্ডের প্রাক্তন বিচারক তথা সমাজতাত্ত্বিক কুনাল দে বলছেন, “শিশুরা স্নেহের বড় কাঙাল। নিঃশর্ত ভালবাসাই এক শিক্ষককে তাদের প্রিয়পাত্র করে তুলতে পারে। শাসন নয়। তা ছাড়া, সুপ্রিম কোর্টের নিয়মানুসারে শিক্ষাক্ষেত্রে কোনও শাস্তি, তা সে শারীরিক বা মানসিক যা-ই হোক, আইনত দণ্ডনীয়। জুভেনাইল জাস্টিস অ্যাক্ট-২০০০ অনুসারে স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের মারধর তো দূর, তাদের বিদ্রুপ বা হেয় করার শাস্তিও ৬ মাস জেল এবং জরিমানা।”
চন্দননগরের বাসিন্দা, আহত ঈশান বলে, “আমাদের কয়েকজন ফোমের বোতল নিয়ে খেলছিল। আমি ওদের সামলাচ্ছিলাম। কিন্তু সুবীর স্যার ঘরে ঢুকে প্রথমে আমাকেই ওই ক্যান দিয়ে মাথায় মারেন। তার পরে অন্যদেরও মারধর করেন।” তার সহপাঠী কৌশিক বলে, “সুবীর স্যার খুব মারধর করেন। তাই সব সময়েই ভয়ে থাকি।”
শিক্ষক সম্পর্কে ছাত্রের সম্ভ্রম থাকতে পারে, কিন্তু এ ধরনের ‘ভয়’ থাকা ‘অভিপ্রেত নয়’ বলে মত সমাজতত্ত্বের শিক্ষক সুধীরঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের। তাঁর কথায়, “ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের সঙ্গে সহিষ্ণুতা নামক যে শব্দটা অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে ছিল তা ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। পারিবারিক সমস্যা থেকে প্রতিষ্ঠানের বিবিধ চাপ মাথায় নিয়ে যে শিক্ষকেরা এখন স্কুলে আসছেন, তাঁদের অনেকের কাছে সহিষ্ণুতা বড় দূরের শব্দ। সে জন্যই এমন দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটছে।”
|