|
|
|
|
প্রবন্ধ... |
ওয়েন-লি-ডো শিখে নিন
সখা কৃষ্ণকে ডাকতে হবে না |
ওয়েন = মহিলা, লি = রাস্তা, ডো = শক্তি। রাস্তাঘাটে মেয়েরা বিপন্ন, মন্ত্রী-বিধায়করা
তাঁদের পোশাক এবং চালচলন নিয়ে গবেষণা করছেন। উপায়? শিখে এলেন পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায় |
একের পর এক ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি, ইভটিজিংয়ের ঘটনা। ক্ষুব্ধ জাতীয় মহিলা কমিশন পর্যন্ত মন্তব্য করেছে, এত কম ব্যবধানে পশ্চিমবঙ্গে মেয়েদের উপর অত্যাচারের এত ঘটনা আগে দেখা যায়নি। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর তথ্য: ধর্ষণের ঘটনার সংখ্যায় এ রাজ্য ভারতে দ্বিতীয়। ১৯৯০ সালে এখানে মেয়েদের শ্লীলতাহানির ঘটনার সংখ্যা ছিল ৩৫৭, ২০১১ সালে ৩২২০। দেশে মেয়েদের উপর হিংসাত্মক ঘটনা ও অত্যাচারের মোট ঘটনার প্রায় ১৩ শতাংশ হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। প্রশাসন উদাসীন বা অসহযোগী। উপায়?
সম্প্রতি কলকাতায় নারীর উপর হিংসা সংক্রান্ত এক সভায় লিখিত নোট পাঠিয়েছিলেন অসুস্থ, বর্ষীয়ান শিক্ষাবিদ সুকুমারী ভট্টাচার্য। তাতে একটা লাইন ছিল, “চার পাশে গুণ্ডা-মস্তানের বাহিনী তৈরি হয়েছে। মেয়েদের আত্মরক্ষার উপায় শিখতে হবে।” সত্যিই তো, একুশ শতকের মেয়ে সখা কৃষ্ণের ভরসায় থাকবে কেন? সে নিজের ইচ্ছা মতো পোশাকে, নিজের প্রয়োজন মতো সময়ে বাইরে বার হবে, এবং সমস্যায় পড়লে আত্মরক্ষার উপায়ও জানবে। কথাটা নতুন কিছু নয়, সেই ১৩৩৩ বঙ্গাব্দে প্রবাসী পত্রিকার এক সংখ্যায় লেখা হয়েছিল, ‘‘আত্মরক্ষার সামর্থ্য থাকা নারীদের রক্ষণের সর্বোৎকৃষ্ট ও একান্ত আবশ্যক উপায়। দৈহিক পটুতা অর্জন নারীদের শিক্ষার অন্তর্গত। অন্তঃপুরের বাহিরের জগৎ সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ করিয়া সাহস অর্জ্জন এবংবিধ নানা দিক দিয়া তাঁহারা আত্মরক্ষায় সামর্থ্য লাভ করিতে পারেন।’’ কিন্তু উপদেশই সার। মেয়েকে রান্নাবান্না শেখাতে মা-বাবারা যত তাগিদ অনুভব করেছেন তার সিকিভাগও মেয়েকে আত্মরক্ষার উপায় শেখাতে করেননি।
তাই মেয়েরা নিজেরাই উদ্যোগী হয়েছেন। অন্তত কোথাও কোথাও, কিছু কিছু মেয়ে। কিছু দিন আগেই একটা খবর বেরিয়েছিল। চণ্ডীগড়, উত্তর-পূর্ব ভারতের বেশ কিছু রাজ্য, বেঙ্গালুরু, ইন্দৌরের মতো শহরে মেয়েদের বন্দুক বা রাইফেলের লাইসেন্স নেওয়ার হার বেড়ে গিয়েছে। লাইসেন্স নিয়েছেন এমন কয়েক জন মহিলা বলেছেন, রাস্তাঘাটে নিজেদের নিরাপদ মনে হচ্ছিল না, তাই আগ্নেয়াস্ত্র রাখতে চেয়েছেন সঙ্গে। ভারতের প্রায় সব ক’টি মেগাসিটিতেই গত কয়েক বছরে পেপার স্প্রে, চিলি স্প্রে, স্টান গান, টিজার গান-এর বিক্রি দ্বিগুণ হয়েছে। কলকাতাতেও গত এক বছরে একাধিক দোকানে, এবং অনলাইনেও পেপার স্প্রে বা টিজার গানের বিক্রি বেড়েছে। যাঁরা কিনছেন তাঁদের অনেকর বক্তব্য, ব্যবহার না করলেও একটা আত্মরক্ষার জিনিস সঙ্গে রয়েছে এই ভাবনাটাই একটা হিম্মত জোগায়। এতে চেহারার ভাষা, চোখের দৃষ্টি বদলে যায়। অপরাধীরা এগুলো খুব নজরে রাখে। তারা টার্গেট স্থির করে মুলত এই বডি ল্যাঙ্গোয়েজ দেখে, শারীরিক ভাষায় দৃঢ়তা রয়েছে এমন কোনও মেয়েকে ঘাঁটাতে চায় না। |
|
প্রশিক্ষণ। ওয়েন-লি-ডো’র ক্লাস চলছে। কমলপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা |
মুম্বইয়ে বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন মিলে একটা দল তৈরি করেছে। তার নাম ‘ডেয়ার’, বিস্তারে ‘ডিফেন্স এগেনস্ট রেপ অ্যান্ড ইভটিজারস’। এই দলে কয়েক জন বিশেষজ্ঞ রয়েছেন যাঁরা মার্শাল আর্ট শেখানো থেকে মানসিক কাউন্সেলিং, সবই করেন। সুযোগসন্ধানী বা আক্রমণকারীকে ধাপে ধাপে বিভিন্ন ভাবে প্রতিরোধ করা শেখান। প্রথমে বিপদ আঁচ করা শিখতে হবে। মনটাকে যে কোনও পরিস্থিতির মোকাবিলায় প্রস্তুত করা হবে। এর পর মৌখিক প্রতিরোধ, চোখের দৃষ্টিতে প্রতিরোধ শেখানো হবে। পরের ধাপ হল মার্শাল আর্ট। দিনে তিন ঘণ্টার থেকে তিন দিনে ৯০ মিনিট করে ‘সেশন’ রয়েছে। প্রচুর মহিলা শিখছেন।
সুতপা, আয়েষা, সাবিত্রী, পায়েল, দিব্যা, গিত্তার মতো প্রশিক্ষকরা দেশের নানা প্রান্তে মেয়েদের ‘ওয়েন-লি-ডো’ শেখাচ্ছেন। ওয়েন অর্থাৎ ‘মহিলা’, লি মানে ‘রাস্তা’ আর ডো হল ‘শক্তি।’ ‘উইকার সেক্স’ অভিধা ঝেড়ে ফেলে মেয়েদের সমস্ত শক্তিকে কেন্দ্রীভূত করার পাঠ। ক্যারাটে-কুংফু-বক্সিং-জুডো-জুজুৎসু নয়। বরং এই সব মার্শাল আর্ট থেকে অল্প-অল্প করে নেওয়া কিছু কায়দা, তার সঙ্গে নিজের মনের জোরকে অনুভব করতে পারা এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তৈরির ককটেলই হল ‘ওয়েন-লি-ডো’।
সেটা সত্তরের দশকের প্রথম দিক। কানাডার টরন্টো শহরের রাস্তায় পরিবারের এক মেয়ে দুষ্কৃতীদের হাতে লাঞ্ছিত হয়ে খুন হয়েছিল, দাঁড়িয়ে দেখেছিলেন পেজ পরিবারের ক’জন। চার পাশে অনেকে ছিলেন, গুন্ডাদের রুখতে সাহস করেননি। সাহায্য চেয়ে কাউকে পাননি পেজ’রা। কেন কাউকে বিনা প্রতিরোধে এই ভাবে অত্যাচারিত হতে হবে? ভাবতে ভাবতে, এক্সপেরিমেন্টের মধ্যে দিয়ে পরিবারেই জন্ম নিল ‘ওয়েন-লি-ডো’। ২০০০ সাল নাগাদ কানাডীয় বংশোদ্ভূত গিত্তা রিড্ডারের হাত ধরে এল ভারতে।
দক্ষিণ ২৪ পরগনার সাগর, কমলপুর, রুদ্রনগর, ধবলাট-শিবপুর, বঙ্কিমনগর, ধসপাড়া, কীর্তনখালি-র মতো গ্রাম, যেখানে ধর্ষণ, নারী-পাচার, ঘরোয়া হিংসার হার ঊর্ধ্বমুখী, কয়েক বছর ওয়েন-লি-ডো শেখাচ্ছেন সুতপা পাত্র-রা। ধর্ষিতা হওয়ার মতো অবস্থা তৈরি হলে, রাস্তায় কেউ ধাওয়া করলে, টিটকিরি দিলে, ভিড় বাসে-মেট্রোয় কোনও পুরুষ ইচ্ছা করে লিঙ্গ গায়ে ঠেকালে অনেক মেয়েরই ভাবনার শক্তি হারিয়ে যায়, দম আটকে আসে, কান্না পায়। কিছুতেই মোকাবিলা করতে পারেন না। ওয়েন-লি-ডো মেয়েদের সঙ্কটের মুহূর্তে সংকোচ ভেঙে শক্তি আর বুদ্ধির প্রয়োগটা শেখায়। দু’দিনের সেমিনার। বেসিক আত্মরক্ষা শেখা যাবে। আর একটু শিখতে চাইলে দিনে তিন ঘণ্টা করে সাত দিন ট্রেনিং যথেষ্ট। যে কোনও বয়সের মহিলারা শিখতে পারেন।
অনেকে অবশ্য প্রশ্ন তুলেছেন, এই সব প্রশিক্ষণ বা আত্মরক্ষার উপকরণ নিয়ে বেশি প্রচার হলে তার অপব্যবহার বা অপপ্রয়োগ হবে না তো? সুতপাদের বক্তব্য: সেটা মনে করলে তো সব মার্শাল আর্টের স্কুল বন্ধ করে দিতে হয়। কে কোন উদ্দেশ্য নিয়ে আছেন, সেটা বুঝতে মেয়েদের খুব একটা ভুল হয় না। তাই নির্দোষ লোকের হেনস্তা হওয়ার আশঙ্কা কম।
এ রাজ্যেই স্কুলের সিলেবাস নিয়ে কত এক্সপেরিমেন্ট হয়, কিন্তু মেয়েদের স্কুলের সিলেবাসে আত্মরক্ষার কোনও পাঠ্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করার কথা কারও মনে হয়নি। গ্রামে-গ্রামে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মেয়েদের কোনও আত্মরক্ষা-পদ্ধতির প্রশিক্ষণ দিলে তাঁরা মেয়েদের এটা শেখাতে পারেন। বিনিময়ে সরকার তাঁদের মাসে মাসে কিছু টাকা দিতে পারে। কিন্তু এই সব নিয়ে কেউ মাথা ঘামাতে চান না। রাস্তায় বিপদে পড়লে মেয়েরা কোন নম্বরে ফোন করলে সাহায্য পেতে পারে সে সম্পর্কে কোনও প্রচার নেই। শুধু তাঁরা কী পরবেন, মদ খাবেন কি না, লেট-নাইট পার্টি করবেন কি না, তা নিয়ে টেবিল-কাঁপানো আলোচনা রয়েছে।
তবু, শাসক দলের প্রাক্তন নায়ক বর্তমান বিধায়ককে সবিনয় নিবেদন করা যেতে পারে, চিত্রনাট্য একটু-একটু করে বদলাচ্ছে। বিপত্তারণ নায়কের আবির্ভাবের আশা না-করে মেয়েরাই এখন আত্মরক্ষার জন্য পাল্টা মারের ফর্মুলা শিখে নিচ্ছে। |
|
|
|
|
|