সাক্ষাৎকার...
চিনের কাছে ভারত একটা বিপুল বাজার


ঠিকই, ভূ-রাজনীতির দিক থেকে দেখলে চিনের আচরণ ঠিক ভারতের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ নয়। আমার অনুমান, চিন সীমান্ত নিয়ে ভারতের সঙ্গে হয়তো একটা অশান্তি জিইয়ে রাখতে চায়, যাতে ভারত কখনও খুব নিশ্চিন্ত না থাকতে পারে। কিন্তু বাণিজ্যের কথাটাও মাথায় রাখা ভাল। গত তিন দশকে ভারত আর চিনের বৈদেশিক বাণিজ্য ২৩০ গুণ বেড়েছে। আরও বাড়বে। একটা চলতি হিসেব আছে ২০১৫ সালের মধ্যে ভারত আর চিনের বাণিজ্য ১০০ বিলিয়ন ডলার হবে। ভারত আসলে চিনের কাছে একটা বিপুল বাজার। চিন কোনও কারণেই এই বাজারের ক্ষতি করতে চাইবে না। ভারতের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা করলে এই বাজারটা যাবে। চিন সেই ঝুঁকি নেবে কেন? বিশেষ করে এখন পশ্চিমি দুনিয়ার বাজার খুব টালমাটাল, ফলে চিন সেই বাজারের ওপর আর আগের মতো নির্ভর করতে পারছে না। এখন ভারত তাই চিনের কাছে আরও গুরুত্বপূর্ণ। ফলে, যুদ্ধ হবে না বলে ধরেই নেওয়া যায়। তবে সীমান্ত নিয়ে খুচরো সমস্যাও থাকবে। সেটা মেনে নিতে হবে।
মাথায় রাখতে হবে, একুশ শতকে কোনও দেশই ‘যুদ্ধবাজ’ হিসেবে পরিচিত হতে চায় না। চিন নিজের সামরিক শক্তি সমানেই বাড়িয়ে চলেছে। কিন্তু শেষ যুদ্ধ সেই ১৯৭৮ সালে, ভিয়েতনামের সঙ্গে। ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ হলে চিনের এমনিতেই খারাপ ভাবমূর্তি আরও খারাপ হবে। চিন সেই ঝুঁকি নেবে না। তবে চিনের সঙ্গে যুদ্ধের আশঙ্কা নেই ভেবে যদি ভারত নিজের সামরিক শক্তির দিকে মন না দেয়, সেটাও ঠিক নয়। যুদ্ধ এড়ানোর সবচেয়ে ভাল উপায়: যুদ্ধের জন্য সম্পূর্ণ তৈরি থাকা।


তিব্বত নিয়ে এখন যতটুকু কথা বলা সম্ভব, যা করা সম্ভব, তা কিন্তু ভারত করে। এই যে ভারত দলাই লামাকে আশ্রয় দিয়েছে, কোনও চাপেই সেই আশ্রয় প্রত্যাহার করেনি, ধরমশালায় তিব্বতের অনাবাসী সরকার চলছে পুরোটাই তো তিব্বত তাস খেলা। ভারতের পক্ষে আজ আর তিব্বতের ওপর চিনের অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তোলা সম্ভব নয়। আন্তর্জাতিক দুনিয়া তিব্বতকে চিনের অংশ হিসেবে মেনেই নিয়েছে।


হ্যাঁ, সেটা ঠিক। তবে চিন এখনও অবধি বলেছে যে ভারত তার প্রয়োজনীয় জল পাবে। যে উপগ্রহ-চিত্র পাওয়া গিয়েছে, তার থেকেও চিনকে অবিশ্বাস করার মতো কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কিন্তু, পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের যেমন জলবণ্টন চুক্তি রয়েছে, চিনের সঙ্গে তেমন কিছু নেই। কাজেই, তিব্বতের জল পাওয়া যাবে কি না, সেটার জন্য চিনের ওপর বিশ্বাস করা এবং আন্তর্জাতিক মহলের চাপে ভরসা রাখা ছাড়া ভারতের উপায় নেই। যদি জানতে চান এমন চুক্তির প্রয়োজন আছে কি না, আমি বলব অবশ্যই আছে। তাতে চিনকেও একটা বার্তা দেওয়া যাবে।

উৎসবে ব্যসনে চ... কলকাতা শহরে চিনা নববর্ষ উদযাপন, জানুয়ারি ২০১২।

এ ভাবে না দেখাই ভাল। শ্রীলঙ্কার হাম্বাটোটা বন্দরের উদাহরণটিই নিন। ওই বন্দরটি শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মহেন্দ্র রাজাপক্ষ-র নিজের নির্বাচনী ক্ষেত্রে। তিনি সেখানে একটা বন্দর চাইছিলেন। তিনি প্রথমে ভারতের কাছেই বন্দর তৈরি করে দেওয়ার আবেদন জানান। ভারত রাজি হয়নি। তার পর তিনি চিনের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। চিন দেড়শো কোটি ডলার খরচ করে বন্দর নির্মাণ করে দিয়েছে। সেটাকে চিনের আগ্রাসন বলতে আমার আপত্তি আছে। ভারত করেনি, চিন করেছে। আর, চিনও ভারতের সম্পর্কে একই অভিযোগ করতে পারে। ভারত কাজাখস্তানে বিমানঘাঁটি বানিয়েছে। ভিয়েতনামের সঙ্গে নানা রকম চুক্তি করেছে, যার মধ্যে নৌসেনার যৌথ মহড়াও আছে। আবার, মায়ানমারে চিনও বন্দর তৈরি করছে, ভারতও করছে। কাজেই, পুরোটাকে অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের হিসেব থেকে বেরিয়ে এসে দেখতে হবে। ভারতকে নিজের প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে স্বপ্রবৃত্ত হয়ে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। চিন কী করল, তা নিয়ে মাথা ঘামানোর চেয়ে এটা বেশি জরুরি।


নিঃসন্দেহে। শুধু ভারত নয়, এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলি জাপানের দিকেও তাকিয়ে রয়েছে। ভূগোলের কথা ভাবলে পরিষ্কার হবে, চিন নিজের অবস্থানের দরুন দক্ষিণ-পূর্ব এবং পূর্ব এশিয়ায় একাধিপত্য কায়েম করতে পারে। সেটা এই অঞ্চলের দেশগুলোর কাম্য নয়। ফলে, ভারতকে তারা চাইছে। ভারতকে তো কোনও ভাবেই পূর্ব এশিয়ার দেশ বলা চলে না, তবুও এই দেশগুলি ভারতকে ‘ইস্ট এশিয়ান সামিট’-এর সদস্য করেছে।


মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চিনের সম্পর্ক কিন্তু অনেক গভীর। চিনে বিপুল মার্কিন বিনিয়োগ রয়েছে, আবার মার্কিন ট্রেজারি বিলের একটা বড় অংশ চিনের হাতে। ফলে, ভারতের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ যতখানি জড়িত, চিনের সঙ্গে তার চেয়ে অনেক বেশি। আবার অন্য দিকে, ভারতের কাছেও এই দুটো দেশের সঙ্গেই সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ। চিনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক কী হবে, সেটা মার্কিন স্বার্থের কথা মাথায় রেখে স্থির করার কোনও প্রশ্নই নেই। এমন পরিস্থিতি তৈরি হতেই পারে যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে চটিয়েও ভারতকে চিনের সঙ্গে সম্পর্ককেই বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। আবার উল্টোটাও হতে পারে। আমি বলতে চাইছি, ভারত-চিন সম্পর্ক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছা অনুযায়ী চলবে না।


শুধু যে বিনিয়োগের মাধ্যমেই কূটনৈতিক প্রতিপত্তি তৈরি করা সম্ভব, তা তো নয়। ভারতের কর্তব্য, প্রতিবেশী দেশগুলিকে নিজের আর্থিক সমৃদ্ধির অংশী করে নেওয়া, যাতে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা বা মায়ানমারের দেশগুলির স্বার্থ জড়িয়ে থাকে। ভারতকে এগিয়ে এসে এই দেশগুলোর জন্য নিজের বাজার খুলে দিতে হবে। ভারতীয় বেসরকারি সংস্থাগুলি এই দেশগুলোতে বিনিয়োগ করতে পারে। তাতে সংস্থাগুলিরও লাভ। বাংলাদেশে বস্ত্রশিল্পে বিনিয়োগ করার সম্ভাবনাই ভেবে দেখুন। সে দেশে দক্ষ শ্রমিক রয়েছে, ভাল পরিবেশ রয়েছে। রফতানি কোটার সুবিধাও পাবে ভারতীয় সংস্থাগুলি। অন্য দিকে, যে মুহূর্তে এই সংস্থাগুলি বাংলাদেশে কর্মসংস্থান করবে, সেই মুহূর্তেই সাধারণ মানুষের মনে ভারতের প্রতি একটি ইতিবাচক মনোভাব তৈরি হবে। রাজনীতিকদের পক্ষে সেই মনোভাবকে অস্বীকার করা কঠিন।


প্রথম কথা, ‘চিন্ডিয়া’ জাতীয় সরলীকরণকে আমিও অর্থহীন মনে করি। ভারত আর চিন, দুটো দেশই এশিয়ায় আর দুটো দেশেরই জনসংখ্যা বিপুল, এ ছাড়া এদের মধ্যে মিল খোঁজার চেষ্টা অর্থহীন। দ্বিতীয় কথা, ভারতের পক্ষে অদূর ভবিষ্যতে চিনের সমান হওয়া বিভিন্ন কারণে অসম্ভব। সত্যিই, তার প্রয়োজনও নেই। উন্নয়ন তো কোনও প্রতিযোগিতা নয়। ভারত যদি নিজের দেশের মানুষের জন্য যথেষ্ট কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারে, যথেষ্ট খাবার জোগাতে পারে, তবে চিন আরও বেশি পারল কি না, তা নিয়ে ভাবার দরকারই নেই। এই দুনিয়ায় দুটো দেশের একই সঙ্গে উন্নতি হওয়ার মতো সুযোগ রয়েছে। প্রশ্ন হল ভারত সেই সুযোগ কাজে লাগাতে পারবে কি না।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.