|
|
|
|
‘জাতীয় শিক্ষক’ পশ্চিমের চার শিক্ষাব্রতী |
নিজস্ব সংবাদদাতা • ঝাড়গ্রাম ও মেদিনীপুর |
কাল, শিক্ষক দিবসে ‘জাতীয় শিক্ষক’-এর সম্মানে ভূষিত হচ্ছেন পশ্চিম মেদিনীপুরের চার জন শিক্ষক। ঝাড়গ্রাম শহরের শ্রীরামকৃষ্ণ সারদাপীঠ উচ্চ মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা পরিব্রাজিকা আত্মহৃদয়া, ঝাড়গ্রামেরই চুবকা অঞ্চলের রাধানগর আংশিক বুনিয়াদি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রণজিৎ মণ্ডল, সাঁকরাইলের ‘সাঁতকুলি আদিবাসী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে’র প্রধান শিক্ষক হিমাংশু ঘোষ এবং মেদিনীপুর সদরের শিরোমণি বিরসা মুন্ডা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক নির্মলেন্দু দে। নির্মলেন্দুবাবু ছাড়া সকলেই অবসর নিয়েছেন। নয়াদিল্লির বিজ্ঞানভবনে প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে পুরস্কার নেবেন চার জনই।
ঝাড়গ্রামের প্রবীণ শিক্ষাব্রতী পরিব্রাজিকা আত্মহৃদয়া। ‘শ্রীরামকৃষ্ণ সারদাপীঠ কন্যাগুরুকুল’ প্রতিষ্ঠিত শ্রীরামকৃষ্ণ সারদাপীঠ উচ্চ মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের এই শিক্ষিকা ছাত্রীদের কাছে ‘গৌরীদি’ বলেই পরিচিত। গত বছর রাজ্য সরকারের ‘শিক্ষারত্ন’ সম্মান পেয়েছে। মহীশূর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে ডক্টরেট আত্মহৃদয়ার প্রকৃত নাম সুদর্শিনী রাঘবাচার্য। তবে বাংলা ও ইংরেজি দু’টি ভাষাতেই তিনি সমান সাবলীল। |
|
|
|
|
পরিব্রাজিকা আত্মহৃদয়া। |
রণজিৎ মণ্ডল। |
হিমাংশু ঘোষ। |
নির্মলেন্দু দে। |
|
শ্রীরামকৃষ্ণ, মা সারদামণি ও স্বামী বিবেকানন্দের ভাবধারায় প্রাণিত হয়ে ১৯৭৯ সালে ঝাড়গ্রামের কন্যাগুরুকুলে ব্রহ্মচারিণী হিসেবে যোগ দেন। সুদর্শিনী রাঘবাচার্য নাম বিসর্জন দিয়ে ‘ব্রহ্মচারিণী গৌরীদেবী’ নাম হয় তাঁর। সন্ন্যাসপর্বে নাম হয় পরিব্রাজিকা আত্মহৃদয়া। ১৯৮৬ সালে তিনি শ্রীরামকৃষ্ণ সারদাপীঠ স্কুলে সহকারি শিক্ষিকা পদে যোগ দেন। ১৯৯৭ সালে প্রধান শিক্ষিকা হন। গত ফেব্রুয়ারিতে প্রধান শিক্ষিকার পদ থেকে অবসর নেওয়ার পরও নিজের স্কুলে এখন অবৈতনিক ভাবে শিক্ষাদানের পাশাপাশি, দুঃস্থ-আর্তদের সেবা করে চলেছেন এই প্রবীণ সন্ন্যাসিনী। আদিবাসী অধ্যুষিত ঝাড়গ্রামে নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে আত্মহৃদয়ার ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। তাঁর কথায়, “জঙ্গলমহলে নারীর ক্ষমতায়ন প্রতিষ্ঠার লক্ষেই জীবনভর আমার ব্রত। অগণিত ছাত্রী, অভিভাবক, সহশিক্ষিকা, আশ্রমসাথী ও শুভানুধ্যায়ীদের ভালবাসা, প্রেরণা ও সমর্থনের ফলেই এই পুরস্কার প্রাপ্তি। পুরস্কারের শরিক তাঁরাও।”
ঝাড়গ্রামের চুবকা অঞ্চলের রাধানগর আংশিক বুনিয়াদী বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের পদ থেকে ৩১ অগস্ট অবসর নিয়েছেন রণজিৎ মণ্ডল। বাড়ি সর্ডিহায়। যৌথ পরিবারের সদস্য রণজিৎবাবু দীর্ঘ চার দশকের শিক্ষক-জীবনে তাঁর প্রিয় শিক্ষাঙ্গণকেই স্বপ্নসম্ভব হিসেবে গড়ে তুলেছেন। ঝাড়গ্রামে বুনিয়াদী প্রশিক্ষণ (বেসিক ট্রেনিং) নেওয়ার পর ১৯৭৪ সালে রাধানগরের স্কুলটিতে সহ-শিক্ষক পদে যোগ দেন। ২০০৩ সালে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পান। সরকারি সাহায্যের ভরসায় না থেকে এলাকাবাসীর দানে স্কুলের উন্নয়ন ঘটানো রণজিৎবাবুর বক্তব্য, “বাকি জীবনটা নিজের প্রিয় স্কুলের উন্নয়ন ও শিক্ষাক্ষেত্রেই সঁপে দিতে চাই।” স্কুলের জমিতে মূল্যবান ৫০টি গাছ লাগিয়ে সেগুলির নিত্য পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণ করেন। স্কুল প্রাঙ্গণে মনীষীদের মূর্তি স্থাপন করেছেন। বিপদে-আপদে দুঃস্থদের জন্য অর্থ সাহায্য করেন। গত বছর জেলার অন্যতম সেরা শিক্ষক হয়েছেন। অবসর গ্রহণের দিন সেই পুরস্কারের টাকা স্কুলের তহবিলেই দান করেছেন রণজিৎবাবু।
সাঁকরাইলের লাউদহতে বাড়ি হিমাংশু ঘোষের। ছোট থেকেই স্বপ্ন দেখতেন শিক্ষক হওয়ার। গরিব মানুষের পাশে দাঁড়ানোর। লাউদহের কিছু দূরেই সাঁতকুলি। এখানে প্রাথমিক স্কুল ছিল না। ১৯৭০ সাল, হিমাংশবাবুর তখন আঠারো। নিজের উদ্যোগেই একটি স্কুল চালু করলেন। তখন খড়ের চালের বাড়িতে মেঝেতে বসেই পড়াশোনা চলত। সরকারি অনুমোদন মিলল ’৭৩ সালে। স্কুলের নাম ‘সাঁতকুলি আদিবাসী প্রাথমিক বিদ্যালয়’। এখন অবশ্য স্কুল ক্যাম্পাস ও তাঁর চারপাশের পরিবেশ পাল্টেছে। শিক্ষক জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রধান শিক্ষক পদে একই স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন হিমাংশুবাবু। গত ৩১ মে প্রধান শিক্ষক হিসেবে অবসর নেন। তাঁর কথায়, “শুরুতে সংগঠক-শিক্ষক হিসেবেই কাজ শুরু করেছিলাম। তখন পাকা বাড়ি ছিল না। খড়ের চালের বাড়িতেই পড়াশোনা হত। সেই সব দিনের কথা মনে পড়লে আজও মন কেমন করে। স্কুলের উন্নয়নে গ্রামবাসীরা নানা ভাবে সহযোগিতা করেছেন। তাঁদের সহযোগিতা না-থাকলে স্কুলকে এগিয়ে যাওয়া অসম্ভব ছিল।” বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজেও নিজেকে জড়িয়ে রাখেন। যে মাইনে পেতেন, তার একাংশও গরিব ছাত্রছাত্রীদের জন্য খরচ করতেন। তাদের বইপত্র কিনে দিতেন। কাউকে শীতে কষ্ট পেতে দেখলে কম্বল কিনে দেন। হিমাংশুবাবুর কথায়, “গরিব মানুষের সেবা করতে পারলে আমি মন থেকে তৃপ্তি পাই। এ বার রাষ্ট্রপতি আমাকে সংবর্ধিত করতে চলেছেন। আমি কৃতজ্ঞ।” সবংয়ের তেমাথানির বোয়ালিয়ায় আদিবাড়ি নির্মলেন্দু দে’র। সুযোগ পেলে সমাজের অনুন্নত সম্প্রদায়ের পাশে দাঁড়ান। গল্প-কবিতা লেখেন। শিক্ষকতা শুরু ’৭৪ সালে, লক্ষা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। প্রায় ১৩ বছর সেখানে শিক্ষকতা করেছেন। ’৮৬ সালে ঝাড়গ্রামের খালশিউলি হাইস্কুলে যোগ দেন। ২০০১ সালে চলে আসেন মেদিনীপুর সদরের শিরোমণি বিরসা মুন্ডা হাইস্কুলে। প্রধান শিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করেন। এখন মেদিনীপুরের নজরগঞ্জে থাকেন। আগামী ডিসেম্বরে অবসর নেবেন। তাঁর আমলেই শিরোমণির এই স্কুলটি জুনিয়র হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক ও পরে উচ্চমাধ্যমিক স্তরে উন্নীত হয়েছে। এক সময় মাদুর শিল্পীদের এবং কৃষকদের সাহায্যের লক্ষে ‘মাদুর শিল্পী ও কৃষি উন্নয়ন সমিতি’ গড়ে তুলেছিলেন। নির্মলেন্দুবাবু বলেন, “সুযোগ পেলেই সমাজসেবামূলক কাজে এগিয়ে আসি। সে জন্যই বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থার সঙ্গে যুক্ত হয়েছি।” তাঁর কথায়, “রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পাওয়ার কথা, কখনও ভাবিনি। এই সম্মানের জন্য সরকার আমাকে মনোনীত করেছে। আমি কৃতজ্ঞ। সব সময়ই গরিব মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করেছি। আগামী দিনেও এই চেষ্টা থাকবে।” নির্মলেন্দুবাবুর উদ্যোগেই এক সময় তাঁর নিজের গ্রাম বোয়ালিয়াতে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র চালু হয়। |
—নিজস্ব চিত্র। |
|
|
|
|
|