|
|
|
|
প্রবন্ধ ২... |
ধরণী খুড়ার ইচ্ছা তবু অদম্য |
এই ইচ্ছা যে, ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখবে, তাদের চোখ ফুটবে।
এই ইচ্ছা পূরণের জন্য কী করণীয়? উত্তর খুঁজেছেন সংগ্রাম মুখোপাধ্যায় ও সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায় |
হাযে কাড়াটা বাঁধা আছে, হামরা উয়ার লেও অধম। কেনে? উয়াকে ছাড়্যেঁ দিলে চর্যেঁ খায়্যেঁ বাঁচ্যে থাক্যবে। মানুষ পারব্যেক নাই। মানুষকে খাট্যেঁ খাতে হবেক, যদি না সে মানুষ হয়। ঘর্মস্রাবী জীবনের লবণাক্ত অভিজ্ঞতায় ধরণী খুড়া তুলে ধরেন মানুষের মানুষ হওয়ার ব্যাখ্যা। ‘সে-ই মানুষ, যার চইখ ফুট্যেছে। যে পঢ়ালিখা করি জগৎটাকে দেখতে পায়।’
ধরণী খুড়া বঞ্চিতদের অক্ষমতাটা বোঝেন বলেই তাঁর অদম্য ইচ্ছা যে, তাঁর ছেলেমেয়ের লেখাপড়া করে চোখ ফুটুক, তা হলে সে নিজেই ভালমন্দ, গুণাগুণ বাছতে পারবে। অর্থাৎ, প্রথম কথা হল শিক্ষার সুযোগ: শিশু স্কুলে ভর্তি হতে পারছে কি না এবং কোন স্তর পর্যন্ত শিক্ষা নিতে পারছে, এই দুটোর উপরই অনেকখানি নির্ভর করে শিক্ষার গুণমান। ইউ এন ডি পি-র মানব উন্নয়ন সূচক শিক্ষার যে মানটা নেয়, সেটা এই দু’টির যুক্ত ফল। আজ ধরণী খুড়ার যে মূল্যায়ন, সেটা এসেছে প্রথমটা থেকে। তাঁর ছোটবেলায় মা-বাবা এমনটা যে ভাবতে পারেননি, তার কারণ এই নয় যে, তাঁরা ধরণী খুড়ার চেয়ে কিছু কম ‘দ্রষ্টা’ ছিলেন। বরং কারণটা এই যে, স্কুল যে একটা জায়গা, যেখানে সবাই যেতে পারে, এমন বিশ্বাসের ভিত্তি তাঁদের ছিল না। প্রথমত, স্কুলের সংখ্যা ছিল কম, আর দ্বিতীয়ত যা-ও বা ছিল, তাতে নানান কারণে সবার যাওয়ার উপায় ছিল না। কিন্তু আজ সত্যিই অবস্থাটা বদলেছে। শিশুভর্তির সংখ্যা বেড়েছে, স্কুলছুটের হার হ্রাসমান। কিন্তু শিক্ষার যে তৃতীয় মাত্রা-গুণমান তা নিয়ে এক কথায় কিছু বলা সম্ভব নয়। এটা নিয়ে অসন্তোষ বা আত্মসন্তোষ দুটোই নিবিড় পরীক্ষানিরীক্ষার দাবি রাখে।
|
শুধু গরিব-বড়লোক নয় |
‘ভর্তি তো হচ্ছে, স্কুলেও আসছে, কিন্তু শিখছেটা কী?’ আমরা হামেশাই এ প্রশ্নটার সম্মুখীন হই। এই যে কিছু শিখছে না বলে বলা হচ্ছে, এ বিবৃতিটা তো অসত্য নয়। নানা সমীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ থেকে দেখতে পাচ্ছি, একটা অংশের শিশুরা তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণিতে উঠেও নিজের নাম লিখতে পারছে না। কিন্তু প্রতীচী ট্রাস্টের সমীক্ষায় এই মাত্রাটা কমছে বলেও দেখতে পাচ্ছি। ২০০৮-০৯ ও ২০১১-১২-র দুই সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, নিজের নাম লিখতে না-পারা-শিশুর অনুপাত ৪ শতাংশ; ২০০১-০২-এ অনুপাতটি ছিল ৩০ শতাংশ। এত চেষ্টাচরিত্রর পরেও যে একটা অংশ ‘কিছুই শিখে উঠতে পারছে না’, সে উদ্বেগ রাজ্যের সামাজিক চেহারাটা চোখের সামনে মেলে ধরে। কারা এরা, যারা শিখতে পারছে না? এরাই বা কারা, যারা কিছু শিখছে? আর ওরাই বা কারা, যাদের প্রাপ্ত নম্বর ৯৯ না হয়ে ৯৮ হয়ে গেলেই মা-বাবা সন্তানকে সারা রাত জাগিয়ে পড়া মুখস্থ করাচ্ছেন? |
|
সমাজের বিভিন্ন স্তরে ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠীর ছবি এটা। শুধু গরিব-বড়লোক নয়, এ বিভাজনের একটা রূপ হচ্ছে সামাজিক পরিচিতি উচ্চবর্ণ বনাম নিম্নবর্ণ হিন্দু ও মুসলমান। গুণমানের যেমন একটা শ্রেণিবিভাজন আছে, তেমনই অসন্তোষেরও একটা বিভাজন আছে। এই বিভাজনে ক্রমশ নম্বর-কেন্দ্রিক এবং অবশ্যই প্রাইভেটধর্মী শিক্ষার তথাকথিত উৎকর্ষ উপর থেকে নীচে চুঁইয়ে পড়ছে। সমাজের বিপুল অংশের জন্য যেটা বরাদ্দ করে রাখা হয়েছে, নীতিনির্ধারক থেকে বিশেষজ্ঞ পর্যন্ত কেউই এটাকে দয়ার দানের চেয়ে বেশি কিছু মনে করেননি। ‘হাভাতে’, ‘গরিব’, ‘ছন্নছাড়া’র দলের আর কী দরকার? সরকারি স্কুল তো করে দেওয়া হয়েছে! সরকারি স্কুলগুলোতে কী দেওয়া হয়েছে, কী তার পরিকাঠামো, কত তার শিক্ষক, কী তাঁদের প্রশিক্ষণ, এ সব প্রশ্ন না করেই এক দল দাবি করেন, শিক্ষাব্যবস্থাকে বেসরকারি উদ্যোগের হাতে তুলে দেওয়া হোক। প্রশ্নও তোলা হয়, ‘মাস্টার তো পড়ায় না’, তাদের মাইনে দিয়ে ‘পুষে’ লাভ কী? সরকারি স্কুলে পড়া শিশুদের তিন-চতুর্থাংশই যখন টিউশন পড়তে যায়, সরকারি স্কুল থেকেই বা কী লাভ?
কিন্তু এই বাস্তবতার অন্য একটা রূপও তো আছে, বাণিজ্যিক চোখ প্রায়শই সে রূপটা দেখতে পায় না। এই যে প্রাইভেট টিউশনের প্রাবল্য, নিরক্ষর পিতামাতারও প্রাইভেট স্কুলের প্রতি ঝোঁক, সেটা তো সরকারি স্কুল প্রসারেরই ফল। যেমন যেমন ভাবে শিক্ষাব্যবস্থা জনসাধারণের কাছে পৌঁছচ্ছে, তেমন তেমন ভাবে কী পড়ানো হচ্ছে, সেই সম্পর্কিত চেতনা নানা স্বরে কথা বলতে শুরু করেছে।
ভিন্ন স্বরগুলি কেমন? একটা স্বর ধরণী খুড়ার, যা অতি অল্পে সন্তুষ্ট। একটা স্বর পিটুলিগোলা দিয়ে কাজ চালায়। আর একটা স্বর চায় প্রতিযোগিতামূলক উৎকর্ষ। সে দিন একটা স্কুলে দেখে এলাম, দু’জন শিক্ষক থাকা সত্ত্বেও সব শিশু প্রাথমিক শিক্ষার সব ক’টি সূচকের দিক দিয়ে বেশ ভাল ফল করছে। কিন্তু তবু তুলনায় সচ্ছল মা-বাবারা শিক্ষকের উপর চাপ দিচ্ছেন প্রাইভেট পড়ানোর জন্য। কেন? ভাল পড়ছে, কিন্তু ভাল হাই স্কুলে ভর্তি হতে গেলে ‘আরও ভাল’ পড়তে হবে। ভাল সম্পর্কিত ধারণাটি খুবই ধোঁয়াটে। কিন্তু প্রতিযোগিতা নিয়ে যে চেতনা, আর তার উৎস যে সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থার প্রসার, তার ভূমিকার প্রতি চোখ বন্ধ করে রাখা চলে?
|
ডাইনি না খুঁজে |
বক্তব্য এই নয় যে, যা চলছে তা খুবই ভাল ভাবে চলছে, বরং উল্টোটা। যা চলছে, তার একটা আমূল পরিবর্তন দরকার। কিন্তু সেটা আনতে হলে আমাদের শিক্ষার বিভিন্ন সংযোগগুলিকে একসঙ্গে মিলিয়ে দেখতে হবে। মাস্টাররা কিছুই পড়াচ্ছেন না, এটা যেমন ভুল, তেমনই মাস্টার নেই, ঘরবাড়ি নেই, তাই পড়ানো যাচ্ছে না, এটাও ভুল। রাজ্যে শিক্ষা ক্ষেত্রে কাজের সুবাদে আমরা কয়েক হাজার প্রাথমিক শিক্ষকের সংস্পর্শে আসার সুযোগ পেয়েছি। এঁদের একটা বড় অংশ কর্মনিষ্ঠ, তাঁরাই ব্যবস্থাটা টিকিয়ে রেখেছেন। আবার একটা অংশ নিজেকে বাদ দিয়ে বিশ্বসংসারে সব কিছু নিয়েই বিরূপ। আমরা প্রশ্ন করেছি, স্কুলে যা নেই তা নেই, যা আছে, সেটারই বা সদ্ব্যবহার হয় না কেন? কেন শৌচালয়গুলি ব্যবহৃত হবে না? কেন শিশুরা মিড-ডে-মিল খাওয়ার আগে ও পরে হাত ধুতে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে না? কেনই বা তাদের রিডিং পড়া, যোগবিয়োগ করার দক্ষতা চার বছরেও সম্পন্ন হতে পারবে না?
উত্তরগুলো আলাদা। কোথাও হয়তো শিক্ষকের চরিত্র-বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে যুক্ত, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই অসমঞ্জস ব্যবস্থার ফল। আমরা যখন শিক্ষকদের দায়ী করে একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাই, তখন এটা লক্ষ করি না যে, অনেক শিক্ষক ভাল কাজ করছেন, তাঁদের কাজ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। কিন্তু কোথাও তাঁদের এই স্বীকৃতি নেই। এক বিপুল বিচ্ছিন্নতাই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য। বিচ্ছিন্নতা নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে তাঁদের অধস্তনদের, সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে শিক্ষকের, সর্বোপরি শিক্ষকের সঙ্গে জনসাধারণের। এই বিচ্ছিন্নতায় শিশুর অস্তিত্বটাই ধোঁয়াটে। আমাদের দলীয়তা-পঙ্কিল ক্ষুদ্র স্বার্থের রাজনীতি কখনওই শিক্ষার প্রকৃত গণতন্ত্রীকরণের রাজনীতিটাকে স্বীকৃতি দেয়নি। এ রাজনীতি সব কিছু বিশেষজ্ঞদের হাতে ছেড়ে দিয়েছে। গণ-চেতনা ও ক্ষমতায় বিশ্বাস না রেখে তাকে অবদমিত করার দিকেই তার ঝোঁক।
উল্টো দিকে, যাঁদের কাজে ত্রুটি ঘটে, তাঁদের ক্ষেত্রে সে ত্রুটি দূর করার ব্যবস্থা প্রায় অদৃশ্য। পরিদর্শন ব্যবস্থা না থাকারই সমান। ট্রেনিং-এর নামে যা হয়, সেটা একটা বড়সড় তামাশা। গোটা ব্যবস্থায় বিপুল বৈষম্য। সমাজের সব থেকে নীচে যাদের অবস্থান, তাদের জন্য এক রকম এস এস কে, এম এস কে, এক শিক্ষক/ দুই শিক্ষক দিয়ে স্কুল চালানো, ইত্যাদি, আর ক্ষমতাবানদের স্বাধীনতা কেনার জন্য শিক্ষার পণ্যসম্ভার। ধরণী খুড়ারা আজও নিজেদের গর্তে ঢুকে যাওয়া চোখ থেকে চোখ ফোটাবার স্বপ্ন তুলে আনেন, কিন্তু সরকারি কর্তা থেকে মাস্টারমশাই পর্যন্ত অনেকেরই প্রবল বিশ্বাস যে ওদের কিছু হবে না, ওরা প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া। প্রতিযোগিতাকে পূর্ণ উপযোগী হয়ে উঠতে গেলে তাতে প্রত্যেকের যোগ দেওয়ার সুযোগটা এক মৌলিক শর্ত। সেটা সরকারি শিক্ষাব্যবস্থাই পারে, কিন্তু তার জন্য তাকে এমন ভাবে বদলানো দরকার, যাতে শুধু সংগঠন বাড়ানোই নয়, সেটার সমতাপূর্ণ ব্যবহারও নিশ্চিত হতে পারে। এখনও দেখছি সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া এলাকাগুলিতেই সংস্থানের সবচেয়ে অভাব। দ্বিতীয়ত, শিক্ষা বিষয়ে সিদ্ধান্তে শিক্ষক-সহ সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বরগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করা। তৃতীয়ত, ট্রেনিং ও পরিদর্শন ব্যবস্থার খোলনলচে বদলানো এবং এ দুটোকে নামে নয়, প্রকৃত অর্থেই বৈজ্ঞানিক করে তোলা। কিন্তু সর্বাগ্রে চাই পরিবর্তনের রাজনৈতিক সদিচ্ছা। তার জন্য সমাজ ও সরকার কতটা প্রস্তুত?
|
প্রতীচী ইনস্টিটিউট-এ গবেষক |
|
|
|
|
|