স্বাতী ভট্টাচার্যের পর্যবেক্ষণে গ্রামবাংলার পঞ্চায়েত ও মানুষের অবস্থার যথার্থ রূপ ধরা পড়েছে। (‘ওর চটি দূর হটো...’, ১১-৭) এই সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে পরিকল্পনা রচনা ও তার রূপায়ণে গ্রামের মানুষকে সরাসরি যুক্ত করার উদ্যোগ বেশ কয়েক বার নেওয়া হয়েছে। যার কয়েকটির উল্লেখ শ্রীমতী ভট্টাচার্য করেছেন। এই সব উদ্যোগ সফল না-হওয়ার মূল কারণ যে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সরকারি/পঞ্চায়েত কর্মীদের আন্তরিক সহযোগিতার অভাব, তা নিয়ে বিতর্কের জায়গা খুব একটা নেই। কিন্তু প্রসঙ্গত তিনি যখন বলেন যে, গ্রামের মানুষদেরও পরিকল্পনায় অংশ নেওয়ার চাড় নেই, তখন তাঁর সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত হওয়া যায় না। সুযোগ দিলে ও তাঁদের উপর আস্থা রাখলে তাঁরা সে কাজে শরিক অবশ্যই হন।
ক্ষমতা তথা গ্রামীণ উন্নয়ন প্রক্রিয়ার বিকেন্দ্রীকরণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল ২০০৩ সালের পঞ্চায়েত আইন সংশোধন, যার দ্বারা গ্রাম উন্নয়ন সমিতি গঠনের ব্যবস্থা হয়। অনেক রাজনৈতিক নেতা, সরকারি কর্মী এবং বিশেষজ্ঞের বহু আপত্তি ও সংশয় সত্ত্বেও ২০০৫ সালের মধ্যে সম্ভাব্য ৪৫০০০-এর মধ্যে প্রায় ৩৬০০০ গ্রাম উন্নয়ন সমিতি গঠন হয়েছিল। অল্পসংখ্যক হলেও যে সমস্ত গ্রাম উন্নয়ন সমিতিকে প্রাথমিক ভাবে সাহায্য ও পরামর্শ দেওয়া গিয়েছিল, সেখানে এই সমিতিগুলি রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে স্থানীয় মানুষের সহযোগিতায় উল্লেখযোগ্য কাজ করেছে। এর উল্লেখ শ্রীমতী ভট্টাচার্য আগে তাঁর অন্য লেখায় করেছেন। কিন্তু ২০০৮ পঞ্চায়েত নির্বাচনের অব্যবহিত পরে অর্ধেকেরও বেশি গ্রাম উন্নয়ন সমিতি গঠিত হওয়ার পরেও, সমিতি গঠনের সময় অশান্তি হয়, এই অছিলায় গ্রাম উন্নয়ন সমিতিগুলির গঠন অগণতান্ত্রিক এবং তার ভূমিকা লঘু করে দেওয়ায় এগুলি এখন নিষ্ক্রিয় ও কাগুজে প্রতিষ্ঠান হয়ে পড়েছে। ফলে, মানুষ আজ উন্নয়নের পরিকল্পনা করা বা তার রূপায়ণের কাজে নিজেদের শামিল করার সুযোগ পাচ্ছে না। তাদের প্রতিনিধিদের দয়া আর এলাকার রাজনৈতিক দলের সদিচ্ছার উপর ভরসা করা ছাড়া গতি কোথায়? |
পণ্ডিতরা একটি প্রশ্ন তুলবেন। গ্রামের মানুষদের যদি তাদের নিজেদের জন্য উন্নয়ন পরিকল্পনা রচনা করার সুযোগ ও দায়িত্ব দেওয়া হয়, তা হলে তাঁরা কি তা করতে পারবেন? যে সব তথ্য, খবর, হিসাবপত্র, কাগজপত্র দরকার হয় এবং প্রস্তুত করতে হয়, তা তাঁরা পারবেন? এর সোজা উত্তর: না, পারবেন না। আর তা পারারও দরকার নেই। মানুষ তার জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে বলবে, কী তার দরকার, তার অগ্রাধিকার কী, এর মধ্যে কতটা সে নিজে করবে আর কতটার জন্য সরকার বা পঞ্চায়েতের উপর ভরসা করবে। বাকি কাজ তো ‘ফর্ম ফিল আপ’ করা। তার জন্য মাইনে করা লোক আছে। মানুষকে তার কথা নিজের মতো করে বলার সুযোগ দেওয়া হোক। তা যদি গ্রাম উন্নয়ন সমিতির মাধ্যমে না-হয়, তা হলে, আরও ভাল কিছু ব্যবস্থা করা হোক। সেখানেই আছে শ্রীমতী ভট্টাচার্যের লেখায় উত্থাপিত সমস্যার সমাধান।
অমলেন্দু ঘোষ। প্রাক্তন কমিশনার, পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার |