কেননা, আসল বদলটা ঘটে গিয়েছে রাজনীতির ভাষায়।
দলিত ও অনগ্রসর
শ্রেণির
দাবি সেই ভাষায় যে গতিতে জায়গা দখল করে নিচ্ছে,
তাকে
উপেক্ষা
করে
কেবল
উন্নয়নের বুলি দিয়ে আর ভোটে লড়া যাবে না। লিখছেন শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় |
বামপন্থী রাজনীতির, বিশেষ করে কমিউনিস্ট পার্টিগুলির বেশ সংকটকাল চলেছে। এই সংকটের মুহূর্তেই প্রয়োজন হয় আত্মসমীক্ষা। সম্প্রতি খবরে প্রকাশ, অনেক বামপন্থী নেতাই মনে করছেন যে কমিউনিস্ট আন্দোলন যে ভারতের অনেকাংশে, বিশেষ করে উত্তর ভারতে, শিকড় গাড়তে পারেনি তার একটা প্রধান কারণ হল জাতপাত-ভিত্তিক আত্মপরিচয়ের রাজনীতি বা আইডেন্টিটি পলিটিক্স। ঐতিহাসিক দিক দিয়ে দেখতে গেলে এ কথা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, আমাদের কমিউনিস্ট আন্দোলন কখনওই জাতপাত নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায়নি। তার কারণ, এরা বরাবরই আধুনিকতায় বিশ্বাসী। রজনীপাম দত্ত তাঁর ‘ইন্ডিয়া টুডে’ বইতে আশা প্রকাশ করে গিয়েছিলেন যে, ভারতের অর্থনীতির যতই আধুনিকীকরণ ঘটবে, জাতপাতের মতন প্রাক্-আধুনিক চেতনাগুলি ততই স্বাভাবিক ভাবে বিলুপ্ত হবে। তাই কমিউনিস্ট আন্দোলন গোড়া থেকেই শ্রেণি-সচেতনতার ওপর জোর দিয়ে গিয়েছে।
এই নীতি যে একেবারে ফলপ্রসূ হয়নি, তাও নয়। কমিউনিস্ট নেতৃত্বে সংগঠিত তেভাগা-তেলেঙ্গানা কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাসের দিকে তাকালে সে কথা বোঝা যাবে। তেভাগা আন্দোলনে প্রধানত অংশগ্রহণ করেছিলেন রাজবংশী এবং নমঃশূদ্র দুই তফসিলি জাতির দরিদ্র কৃষক। শ্রেণি-সচেতন এই বিপ্লবী কৃষকেরা নিজের জাতের জোতদারদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে দ্বিধা করেননি। মুসলমান ভাগচাষিদের সঙ্গেও তাঁরা সমঝোতা করেছেন। কিন্তু তার ফলে তাঁদের জাতপাতের ধারণাটি মুছে যায়নি। রাজবংশী বা নমঃশূদ্রদের সামাজিক আন্দোলন যার মূলে ছিল জাতপাত-ভিত্তিক আত্মপরিচয়ের রাজনীতি সাময়িক ভাবে দুর্বল হলেও, আবার তা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। অন্য দিকে, তেলেঙ্গানা আন্দোলনেও আমরা দেখেছি সাময়িক ভাবে কাম্মা-রেড্ডি ইত্যাদি কৃষকজাতির বর্ধিষ্ণু চাষিদের সঙ্গে মালা-মাদিগা ইত্যাদি দলিত জাতির কৃষকদের শ্রেণি-ভিত্তিক সমঝোতা হয়েছে। কিন্তু এই সহযোগিতার মধ্যে বিরোধিতার বীজগুলিও থেকে গেছে। দলিত কৃষকরা কখনওই নেতৃত্বে আসতে পারেননি এবং কমিউনিস্ট নেতৃত্ব অস্পৃশ্যতার ব্যাপারটিকে ক্রমাগতই অস্বীকার করে গেছেন।
অর্থাৎ, শ্রেণি-সচেতনতা বাড়লেই যে আমাদের জাতপাতের ধারণাটা সম অনুপাতে কমবে, এমনটা মনে করা ভুল। শ্রেণির সঙ্গে জাতের সম্পর্কটা একটু জটিল। অনেক ক্ষেত্রেই শ্রেণি ও জাতের মধ্যে সামঞ্জস্য দেখতে পাওয়া যায়। অর্থাৎ, অন্ত্যজ জাতের লোক সাধারণত দরিদ্র শ্রেণির অন্তর্ভুক্তও বটে। তবে শ্রেণি বিভাজনের সিঁড়ি বেয়ে আপনি উপরে উঠতে পারেন অথবা পা পিছলে নীচেও পড়ে যেতে পারেন, কিন্তু তাতে আপনার জাত পরিচয় পাল্টাবে না কারণ ওটা জন্মগত। তাই দরিদ্র ব্রাহ্মণ তাঁর ব্রাহ্মণত্ব হারান না, কিন্তু উচ্চবিত্ত তফসিলি জাতির ভদ্রলোককে অনেক সময়ই জাতের কারণে হেনস্থা হতে হয়। এর সঙ্গে ভারতে এখনও জড়িয়ে আছে অস্পৃশ্যতার প্রশ্ন। অর্থাৎ, জন্মগত জাতপরিচয়ের সঙ্গে সম্মান, ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা বণ্টনের সম্পর্কটা অনেক নিবিড়, যেখানে অন্ত্যজ জাতিগুলি একটা চিরস্থায়ী অনগ্রসর অবস্থানে থাকে। এর থেকেই জাতপাত-ভিত্তিক আত্মপরিচয়ের রাজনীতির সূত্রপাত। এটি আমাদের আধুনিকতার একটি বিশেষ দিক। |
বলিষ্ঠ আত্মপ্রকাশ। বহুজন সমাজ পার্টির নির্বাচনী জমায়েত, নয়া দিল্লি, ২০০৯। |
ব্যাপারটা একটু আলোচনা করা যেতে পারে। ঔপনিবেশিক যুগের ভারতে আধুনিকতার ঢেউ সমাজের সর্বস্তরে পৌঁছয়নি। এমনকী যাঁরা উচ্চবিত্ত, উচ্চশিক্ষিত ও আধুনিক হয়ে উঠলেন, তাঁদের কাছেও জাতপাতের তাৎপর্য কিছুই কমল না। কারণ, পশ্চিমি সভ্যতার সাংস্কৃতিক আক্রমণের মুখে জাতিভেদ প্রথা হয়ে দাঁড়াল আমাদের হিন্দুত্বের এবং ভারতীয়ত্বের অনবদ্য প্রতীক। পশ্চিমি শ্রেণিভিত্তিক সমাজের থেকে ভারতীয় বর্ণভিত্তিক সমাজের উৎকর্ষ সম্বন্ধে মহাত্মা গাঁধী সহ অনেক নেতাই একমত ছিলেন। জাতিভেদ প্রথা ভেঙে ফেলার কথা বলতেন দলিত জাতির নেতারা, যেমন জোতিবা ফুলে অথবা ভীমরাও অম্বেডকর। কিন্তু সংখ্যায় তাঁরা ছিলেন অল্প। তাই অস্পৃশ্যতা দূরীকরণের জন্য আন্দোলন হলেও, জাতিভেদ প্রথা ভেঙে ফেলার জন্য কোনও জোরালো সংস্কার আন্দোলন দেখা যায়নি। জাতের পরিচয় তাই এখনও আমাদের সামাজিক পরিচয়ের অঙ্গ।
কিন্তু জাতের পরিচয় কারও কাছে যেমন সোনার হার, কারও কাছে তেমনি লোহার শেকল। কথাটা বলে গিয়েছিলেন ঊনবিংশ শতকের শেষের দিকে সমাজ সংস্কারক যোগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। কাজেই অ-ব্রাহ্মণ ও দলিত জাতিগুলির মধ্যে শেকল ভাঙার মানসিকতা যে ক্রমশ দৃঢ় হবে, বোঝাই যায়। এর থেকেই জন্ম জাত-ভিত্তিক আত্মপরিচয়ের রাজনীতির। ঔপনিবেশিক সরকার জাতিভেদের বাস্তবিকতাকে স্বীকৃতি দিয়ে এই প্রক্রিয়াকে জোরদার করল। সংরক্ষিত আসনগুলিকে কেন্দ্র করে দক্ষিণ, পশ্চিম ও উত্তর ভারতের অ-ব্রাহ্মণ ও দলিত গোষ্ঠীগুলির মধ্যে এক কথায় যাদের দলিত-বহুজন সমাজ বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে শুরু হল রাজনৈতিক আন্দোলন। কারণ, অন্য দিকে, জগজীবন রামের মতন কিছু দলিত নেতার নাম মাঝে মাঝে শোনা গেলেও কংগ্রেস বরাবরই ছিল ব্রাহ্মণ ও অন্যান্য উচ্চবর্ণের নিয়ন্ত্রণে। কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বও গোড়া থেকেই ছিল উচ্চবর্ণের নেতাদের হাতে।
জাত-ভিত্তিক এই যে ক্ষমতার বিন্যাস, ১৯৪৭-এর পর তার কতটা পরিবর্তন হয়েছে? সবচেয়ে বড় পরিবর্তন ঘটেছে তামিলনাড়ুতে, যেখানে কংগ্রেসের হাত থেকে ক্ষমতা ডি এম কে এবং আন্না ডি এম কে-এর হাতে চলে যাওয়ায় ব্রাহ্মণদের হাত থেকে রাজনৈতিক ক্ষমতা অ-ব্রাহ্মণদের হাতে চলে গেছে। উত্তর ভারতে ১৯৮০-র দশক পর্যন্ত, অর্থাৎ যত দিন কংগ্রেস রাজত্ব বজায় ছিল, তত দিন উঁচু জাতের আধিপত্যও কায়েম ছিল। কংগ্রেস প্রথম থেকেই জাতপাতের অঙ্ক মেনে নির্বাচন পরিচালনা করেছে। নেহরু বিহার-উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনপ্রার্থী তালিকায় জাতপাতের উল্লেখ দেখে রেগে উঠতেন ঠিক যেমনটি রাগ দেখাচ্ছেন এখন রাহুল গাঁধী। কিন্তু এই আধুনিকতাপন্থীদের কথায় উত্তর ভারতের জাতপাতের রাজনীতির বাস্তবতা কিছুই পাল্টায়নি। অন্য বড় দল ভারতীয় জনতা পার্টিও উঁচু জাতের স্বার্থই রক্ষা করে চলেছে। অন্য দিকে, ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা থাকলেও, নির্বাচনী রাজনীতিতে বিশেষ কোনও স্থান করে নিতে পারেননি আধুনিকতাপন্থী কমিউনিস্টরাও।
এই অবস্থায় ১৯৯০-র দশক থেকে, অর্থাৎ মণ্ডল-পরবর্তী যুগে, উত্তরপ্রদেশের রাজনীতিতে একটা বিরাট পরিবর্তন এনেছে দলিত নেতৃত্বে বহুজন সমাজ পার্টি (বসপা) এবং ওবিসি নেতৃত্বে সমাজবাদী পার্টি (সপা)। পরিবর্তনটা উল্লেখযোগ্য হলেও আমূল পরিবর্তন নয়। তবে রাজনীতির ভাষাটা গেছে পাল্টে। উন্নয়নের সঙ্গে জাতপাতের যে একটা সম্পর্ক আছে এবং সেই সূত্রে দলিত ও অনগ্রসর জাতিগুলির যে কিছু বিশেষ দাবি রয়েছে, সে কথাটা এই রাজনীতিকরা খোলাখুলি ভাবে বলছেন। আর এর ফলেই আরও কোণঠাসা হয়েছেন কমিউনিস্টরা। আচ্ছা, এই প্রসঙ্গে, বামপন্থী শাসনে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থানটা কী দাঁড়িয়েছে?
অনেকেই মনে করেন পশ্চিমবঙ্গে জাতপাত ব্যাপারটা তত প্রবল নয়। এটা একটা ‘মিথ’। ঔপনিবেশিক যুগে নমঃশূদ্র-রাজবংশী সম্প্রদায়ের প্রতিবাদী আন্দোলনের ইতিহাস পড়লেই সেটা বোঝা যায়। স্বাধীনতা-পরবর্তী যুগেও জাতপাত আমাদের সমাজে ও রাজনীতিতে বেঁচেই রয়েছে। জাতপাতের প্রশ্ন যে কী ভাবে প্রার্থী নির্বাচন ও ভোটদানের প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে, ১৯৫২-র প্রথম নির্বাচনেই তা টের পেয়েছিলেন কমিউনিস্ট নেত্রী মণিকুন্তলা সেন। তাঁর আত্মজীবনীতে সে কথা লিখেও গেছেন তিনি। কিন্তু বিষয়টিকে অস্বীকার করার একটা প্রবণতা বাঙালিদের মধ্যে আছে বিশেষত কমিউনিস্ট নেতৃত্বের মধ্যে তো বটেই। অথচ কমিউনিস্ট আন্দোলনের গোড়া থেকেই এর নেতৃত্বে ব্রাহ্মণ-কায়স্থ-বৈদ্য এই তিন উচ্চ জাতির নেতাদেরই আমরা দেখেছি। এখনও সে অবস্থার তেমন পরিবর্তন হয়নি। অবশ্যই ১৯৭৭-এর পর ওই রাজ্যে জাতপাত ও ক্ষমতার বিন্যাসে খানিকটা পরিবর্তন এসেছে বিশেষ করে নীচের স্তরে, যেখানে অনেক তফসিলি জাতির লোক গ্রাম পঞ্চায়েতে নির্বাচিত হয়েছেন। কিন্তু তাদের মধ্যে পঞ্চায়েত প্রধান হয়েছেন খুব কমই। অর্থাৎ, নীচের স্তরে পরিবর্তন এলেও নেতৃত্বের স্তরে পরিবর্তনটা সীমিতই রয়েছে। তবে এটা ঠিক, এই সব ব্রাহ্মণ-কায়স্থ কমিউনিস্ট নেতারা কখনওই নিজেদের জাতিগর্ব করেন না, নিজেদের কমিউনিস্ট বলে মনে করেন। কিন্তু মূল প্রশ্ন হল, স্বাধীনতার ৬৫ বছর পরেও কেন আমরা কোনও দলিতকে কমিউনিস্ট আন্দোলনের শীর্ষ নেতৃত্বে দেখতে পাই না? এই প্রশ্নের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে উত্তর ভারতের রাজনীতিতে তাঁদের পিছিয়ে পড়ার ব্যাখ্যা।
উত্তরপ্রদেশে যে বসপা ও সপা জাতপাত ও ক্ষমতার বিন্যাসটাকে পুরোপুরি পাল্টে দিয়েছে, তা নয়। ২০০৭-এ বসপা-র নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ২৯.১ শতাংশ ছিলেন ঠাকুর-ব্রাহ্মণ-বানিয়ে-ভূমিহার ইত্যাদি উঁচু জাতের লোক আর ২০১২-এ সপা-র নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ২৭.৫ শতাংশ হলেন এই সব জাতের নেতা। আবার, উত্তরপ্রদেশের মানুষ যে শুধু জাত দেখে ভোট দেন, তাও নয়। অর্থাৎ, দলিত হলেই যে তিনি শুধু বসপা’কে ভোট দেবেন, তা আদৌ নয়। ২০১২-তে সংরক্ষিত আসনের ৫৬টিতে জিতেছে সপা আর ১৬টিতে বসপা। তা হলে পরিবর্তনটা কোথায় ঘটল? পরিবর্তন ঘটেছে নেতৃত্বে ও মন্ত্রীদের মধ্যে দফতর বণ্টনে। দলিত ও ওবিসি নেতারা দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, গুরুত্বপূর্ণ দফতরে মন্ত্রী হচ্ছেন, যা আগে তাঁরা কখনও কল্পনা করতে পারতেন না। এতে ক্ষমতার বণ্টন খানিকটা পাল্টেছে তো বটেই।
তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য তফাতটা ঘটেছে রাজনীতির ভাষায়। দলিত ও অন্যান্য অনগ্রসর জাতিগুলির উন্নয়নের সমস্যাটি যে আলাদা এবং তা বিশেষ অগ্রাধিকার দাবি করে, এই কথাটা রাজনীতির খোলা মঞ্চে উঠে এসেছে। বসপা এবং সপা-র মতো দল উঁচু জাতগুলিকে উপেক্ষা করতে পারছে না ঠিকই, কিন্তু অনেক বেশি অন্তর্ভুক্তিকর বা ইনক্লুসিভ রাজনীতির সূচনা করেছে। সেটা জাতপাতকে অস্বীকার করে নয়, তার বিশেষ চরিত্রকে স্বীকার করে নিয়েই। অর্থাৎ, শুধুমাত্র উন্নয়নের স্লোগান দিয়ে উত্তরপ্রদেশে আর ভোটে জেতা যাবে না। সেই উন্নয়ন বিতর্কে জাতপাতের বিশেষ স্থানকে স্বীকার করে নিতে হবে। এখানেই কমিউনিস্ট নেতৃত্বকে পুরনো কুণ্ঠা কাটিয়ে ভারতীয় সমাজে জাতপাতের বাস্তবতাকে স্বীকার করে নতুন নীতি নেবার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। দলিত ও অন্যান্য অনগ্রসর জাতির নেতাদের দলীয় নেতৃত্বের প্রথম সারিতে তুলে আনার প্রয়োজন পড়েছে, নইলে এ সংকট কাটবে না।
|
নিউজিল্যান্ডের ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি অব ওয়েলিংটন-এ ইতিহাসের শিক্ষক |