গুজবের বিষ ঢেলেছে ৭৬টি পাক সাইট
পাক ছায়াযুদ্ধের নতুন সংস্করণ দেখছে দেশ। আজ এমনটাই দাবি করল দিল্লি। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব আর কে সিংহ আজ জানিয়েছেন, অসমে হাঙ্গামার গুজব ছড়িয়ে সারা দেশে উত্তর-পূর্বের মানুষকে আতঙ্কিত করে তোলার পিছনে রয়েছে পাকিস্তান। হিংসার গুজব ছড়ানোর বিষয়টি নিয়ে এ দিনই তদন্ত শুরু করেছে সিবিআই। প্রয়োজনীয় তথ্য দিলে লক্ষ টাকা পুরস্কার দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে তারা। গুজব ছড়ানোর দায়ে রাজ্যে রাজ্যে শুরু হয়েছে ধরপাকড়ও।
অশান্তির উৎস প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব আজ বলেছেন, “পাকিস্তানের ৭৬টি ওয়েবসাইটকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই সাইটগুলি থেকেই সাজানো ছবি ও আতঙ্কের বার্তা ঢালাও ‘আপলোড’ করা হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সাইক্লোন ও ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত হওয়া মানুষজনের ছবিতেই কারচুপি করে মায়ানমারে সংখ্যালঘুদের উপরে অত্যাচারের ছবি বলে চালানো হয়েছে।” আর তারই জেরে সম্প্রতি ফের হিংসাতপ্ত হয়েছে মুম্বই। দক্ষিণ থেকে দিল্লি, বড়োভূমি থেকে বরাক নতুন এক ছায়াযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়েছে দ্রুত।
উৎকন্ঠার মুখ। হাওড়া স্টেশনে অপেক্ষারত এক যাত্রী।
গোষ্ঠীসংঘর্ষ ও সম্ভাব্য গোষ্ঠীসংঘর্ষ নিয়ে মিথ্যের রং চড়ানো এসএমএস এবং এমএমএস অস্থির করে তুলছে উত্তর-পূর্বের মানুষকে। অসমে কয়েক দিনের হাঙ্গামার জেরে বিভিন্ন ত্রাণ শিবিরে আশ্রয় নেওয়া মানুষ এখনও আতঙ্কে। ঘরে ফিরতে পারছেন না তাঁরা। বড়োদের বরাক ছাড়ার হুমকি দিচ্ছে কিছু সংগঠন। অন্য দিকে তিন দিনে ৩০ হাজার উত্তর-পূর্বের মানুষ দক্ষিণের রাজ্যগুলি থেকে ঘরে ফিরেছেন চাকরিবাকরি, পড়াশোনা শিকেয় তুলে। লেখা ও সাজানো ভিডিও ক্লিপের মোবাইল-বার্তার হানাদারি পৌঁছে গিয়েছে দিল্লিতেও। অকারণে আতঙ্কিত না হওয়ার আবেদন জানিয়েছে দিল্লি পুলিশ। বাড়ানো হয়েছে টহলদারি। যে কোনও সন্দেহজনক বিষয়ে সরাসরি জানানো যাবে দিল্লির পুলিশ কমিশনার নীরজকুমারকে (ফোন: ০১১-২৫৩১৫০০৩ এবং ৯৮১০০৮৩৪৮৬ ই-মেল: robinhibu@gmail.com)।
উত্তর-পূর্বের মানুষ শুধু নয়, চেহারাছবিতে কিছুটা মিল থাকায় উদ্বিগ্ন দার্জিলিঙের গোর্খারাও। বিভিন্ন রাজ্যে তাঁরা ‘হুমকির মুখে’ পড়ছেন বলে আজ অভিযোগ করেছে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা। বিভিন্ন রাজ্যে গোর্খাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আর্জি জানিয়ে তারা আজ স্মারকলিপিও দিয়েছে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে।
ঘুরেফিরে ১৭ বছর আগের স্মৃতিকেই জাগিয়ে দিচ্ছে আজকের এই পরিস্থিতি। ১৯৯৫-এর ২১ সেপ্টেম্বর। গণেশ দুধ খাচ্ছে গোটা দেশে এই গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল অদ্ভুত গতিতে। খবরের বিভিন্ন টিভি চ্যানেল তাদের ‘ক্ষমতা’ দেখিয়েছিল সে বার। আর এ বার ‘দাপট’ বিদেশি ওয়েবসাইট ও মোবাইল ফোনের। এবং ফেসবুক-টুইটারের মতো সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলিরও। প্রযুক্তির অগ্রগতি বরং আরও ঘোরালো করে তুলেছে পরিস্থিতি।
ছায়াযুদ্ধে এঁটে ওঠার প্রথম শর্ত ছায়ার মালিকটিকে খুঁজে বার করা। বিভিন্ন জঙ্গি হামলার ঘটনায় বারবারই দিল্লি সীমান্তপারের সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলে এসেছে। এ বারও অসমে পরপর কয়েকটি অশান্তির ঘটনায় প্রশ্ন উঠছিল, এ সবের পিছনে বিদেশি শক্তির ইন্ধন রয়েছে কি না। সেই সন্দেহই আজ সত্য বলে দাবি করল কেন্দ্র। এবং এর পরপরই অসমের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ বলেন, “গোড়া থেকেই আমি সন্দেহ করছিলাম, এ সবের পিছনে বিদেশি হাত রয়েছে।” কেন্দ্রীয় সরকার জানিয়েছে, পাক সরকারের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলা হবে। এর পাশাপাশি নতুন এই ছায়াযুদ্ধ মোকাবিলায় দেশবাসীর প্রতি দিল্লির বার্তা, সিংহভাগ সাজানো ছবি পাক সাইটগুলি থেকে আপলোড হওয়াটা খুবই সন্দেহজনক। প্রত্যেক দেশবাসীর এটা জেনে রাখা দরকার, পাকিস্তানই এ সব ঘটাচ্ছে। ওই সাইটগুলিকে ইতিমধ্যেই ‘ব্লক’ করা হয়েছে। আরও ৩৪টি সাইটকে চিহ্নিত করা হয়েছে। সেগুলিকেও ‘ব্লক’ করার প্রক্রিয়া চলছে। সেই সঙ্গে হামলার গুজব ও গুজবের হামলা রুখতে ১৫ দিনের জন্য একসঙ্গে বহু এসএমএস এবং এমএমএস পাঠানোর উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক।
রটনা বন্ধে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলিকেও সাময়িক ভাবে ‘ব্লক’ করার দাবি তুলেছেন জেডি-ইউ নেতা শরদ যাদব। যদিও সরকারের তরফে এমন কোনও ভাবনা-চিন্তার কথা জানানো হয়নি।
আতঙ্ক মোকাবিলায় তৎপর রয়েছে সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলিও। যদিও দক্ষিণের তিন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর অভয়বাণী, উত্তর-পূর্বের মুখ্যমন্ত্রীদের আশ্বাস, অসমের চার মন্ত্রীর দাক্ষিণাত্য সফর এবং রটনা দমনে কেন্দ্রের কড়া পদক্ষেপেও মোবাইল থেকে মোবাইলে গুজব ছড়ানো ও ঘরে ফেরার হিড়িক বন্ধ হয়নি।
অসমের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ, মণিপুরের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গাইখংবাম, নাগাল্যান্ডের মুখ্যমন্ত্রী নেফিয়ু রিও, মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী লাল থানহাওলা, মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রী মুকুল সাংমা সকলেই, কেন্দ্র এবং অন্ধ্রপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। দক্ষিণের রাজ্যগুলির মুখ্যমন্ত্রীরা বারবারই অভয় দিচ্ছেন, বেঙ্গালুরু, হায়দরাবাদ, মুম্বই, পুণে ছেড়ে পালানোর প্রয়োজন নেই। গগৈ, রিও, গাইখংবামরাও গুজবের জেরে রুজি-রোজগার ছেড়ে উত্তর-পূর্বের মানুষকে ফিরে আসতে মানা করছেন।
যদিও তাতে ফল মিলছে, এমন ইঙ্গিত কিন্তু পাওয়া যায়নি এ দিন। আজও চারটি ট্রেনে প্রায় পাঁচ হাজার অসমিয়া, বড়ো, নাগা ও মণিপুরী অসমে ফিরেছেন।
কেন্দ্র পাক ষড়যন্ত্রের কথা বললেও জট বাড়াচ্ছে উত্তরপূর্বের জনগোষ্ঠীগুলির নিজস্ব অর্থনীতির প্রসঙ্গও। বেঙ্গালুরু ও হায়দরাবাদ ফেরত অসমিয়াদের দাবি, অল্পশিক্ষিত অসমিয়া ও বড়ো যুবকরাই সেখানকার নিরাপত্তাসংস্থাগুলির বড় ভরসা। সংখ্যালঘুদের উদ্দেশ্য, তাঁদের ফেরত পাঠিয়ে, নিজেদের লোক (কারও কারও দাবি, বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের) নিয়োগ করা। কর্নাটকেই অন্তত এক লক্ষ উত্তর-পূর্বের যুবক নিরাপত্তারক্ষীর কাজ করেন। তাঁদের অনেকেই কাজ ছেড়েছেন। ফলে, কর্নাটকে বিপিও, আইটি, ব্যাঙ্ক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মল, হাসপাতালের মতো বেসরকারি সংস্থায় নিরপত্তা রক্ষী জোগান দেওয়া নিয়েই সমস্যা হচ্ছে। সরকারকে পরিস্থিতি সামলাতে ২ হাজার হোমগার্ড নিয়োগ করতে হয়েছে। রক্ষী সরবরাহের জন্য, জরুরি ভিত্তিতে, পরিচয় যাচাই না করেই রক্ষী নিয়োগ করছে নিরাপত্তা সংস্থাগুলি। অদূর ভবিষ্যতে যা থেকে নতুন-নতুন সমস্যা জন্ম নিতে পারে।
অসমের পরিবহণমন্ত্রী চন্দন ব্রহ্ম ও কৃষিমন্ত্রী নীলমণিসেন ডেকা কর্নাটকের আইনমন্ত্রী এস সুরেশ কুমার, প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি জি পরমেশ্বরকে সঙ্গে নিয়ে আজ বেঙ্গালুরু স্টেশনে যান। ঘরমুখী অসমিয়াদের সঙ্গে কথা বলে থেকে যাওয়ার অনুরোধ করেন তাঁরা। তবে কাজ হয়নি। কর্নাটকের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আর অশোকের সঙ্গে বৈঠকের পরে ব্রহ্ম ও ডেকা অসমিয়া অধ্যুষিত এলাকায় গিয়ে মানুষকে বোঝান। অন্য দিকে, হায়দরাবাদে, অসমের বিদ্যুৎমন্ত্রী প্রদ্যোৎ বরদলৈ ও বনমন্ত্রী রকিবুল হুসেন সিদ্দেকনগর ও আঞ্জাইয়ানগর সরেজমিনে ঘুরে দেখেন। কোন্দাপুরের দু’টি হোটেলে আশ্রয় নেওয়া ৬০ জন অসমিয়া কর্মীকে করজোড়ে হায়দরাবাদ না ছাড়ার অনুরোধ জানান মন্ত্রীরা। সাইবারাবাদে পুলিশ কমিশনারের অফিসে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সবিতা ইন্দিরা রেড্ডি ও পুলিশকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকের পরে প্রদ্যোৎবাবু ঘরে ফেরা বা ঘরমুখী অসমিয়াদের প্রতি আহ্বান জানান, “কাজে ফের যোগ দিন। কারও ছুটি বা বেতন কাটা হবে না। নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে পুলিশ।” মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রী মুকুল সাংমা কেন্দ্র ও উত্তর-পূর্বের সব মুখ্যমন্ত্রীর কাছে চিঠি পাঠিয়ে দক্ষিণ ভারতে যৌথ প্রতিনিধিদল পাঠানোর প্রস্তাব করেছেন। পুণেতে মণিপুরী ছাত্রছাত্রীদের উপরে আক্রমণের জেরে মণিপুর সরকার আজ দুই আইপিএস কর্তাকে পুণে ও বেঙ্গালুরুতে পাঠায়। অতিরিক্ত স্বরাষ্ট্র সচিব এম ইয়াইসকুল গুয়াহাটি থেকে ফেরত আসা মণিপুরীদের ঘরে পাঠানোর ব্যবস্থা করছেন।
কেবল অসমিয়া নন, আজ ৩৭ জন নাগা ও বেশ কিছু মণিপুরী যুবক-যুবতীও অসমে ফেরেন। গুয়াহাটি স্টেশনে অসম সরকার, রেল পুলিশ ও নাগাল্যান্ড প্রশাসনের তরফে সাহায্য-কেন্দ্র খোলা হয়েছে। অসম সরকার স্টেশন থেকে বড়োভূমি যাওয়ার জন্য বিনামূল্যে বাসেরও ব্যবস্থা করে। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এ দিন গুয়াহাটি ও হাওড়া স্টেশনে দীর্ঘযাত্রায় ক্লান্ত যাত্রীদের জন্য স্টেশনে খাবারের ব্যবস্থা করে। হাওড়া স্টেশনে ট্রেন না পাওয়া অতিরিক্ত যাত্রীদের ক্ষোভ-বিক্ষোভ সামলাতে সকাল থেকেই উপস্থিত ছিলেন রেল পুলিশের পদস্থ কর্তারা। ছিলেন পূর্ব রেলের পদস্থ কর্তারাও।

ছবি: রণজিৎ নন্দী



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.