বিশেষ আর্থিক অঞ্চলের তকমা নিয়ে হাজার বিতর্ক সত্ত্বেও রাজ্যের প্রকল্প থেকে হাত গুটিয়ে নেয়নি ইনফোসিস। শুধুমাত্র মেধা সম্পদের টানে। আর এ বার সেই সম্পদকে পুঁজি করেই অ্যানালিটিক্স হাব (তথ্য বিশ্লেষণ কেন্দ্র) গড়ে তোলার পরিকল্পনা করছে রাজ্য।
কেন এই লক্ষ্যে রাজ্য এত মরিয়া? বাজারের লোভনীয় মাপই তা স্পষ্ট করে দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজার সমীক্ষা সংস্থা আইডিসি-র পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত অর্থবর্ষে সারা বিশ্বে এই ব্যবসার অঙ্ক ছিল প্রায় ৩,৫০০ কোটি ডলার। এবং মন্দার চোখরাঙানি উপেক্ষা করেও এই ক্ষেত্রে আগামী দিনে প্রায় ১০% বৃদ্ধির হার বজায় থাকবে বলে আশা সংশ্লিষ্ট মহলের। ২০১৬ নাগাদ ব্যবসা ছাড়িয়ে যাবে ৫ হাজার কোটি। বিপুল সম্ভাবনাময় বাজারের দিকে চোখ রেখে ইতিমধ্যেই এ ক্ষেত্রে পা রেখেছে ওর্যাকল্, আইবিএম, এসএপি, মাইক্রোসফট্-এর মতো তথ্যপ্রযুক্তি বহুজাতিক। আর এই সব সংস্থার লগ্নিকে পাখির চোখ করেই হাব তৈরির কথা ভাবছে রাজ্য।
তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পে (সফট্ওয়্যার) বিনিয়োগ টানার দৌড় অন্য অনেক রাজ্যের তুলনাতেই পিছিয়ে থেকে শুরু করেছিল পশ্চিমবঙ্গ। চিপ ডিজাইনিংয়ে আবার আগে শুরু করেও শেষরক্ষা হয়নি। দৌড় থমকে গিয়েছে মাঝপথে। এই প্রেক্ষাপটে অন্তত তথ্য বিশ্লেষণের ব্যবসায় পুঁজি টানতে গোড়া থেকেই আগ্রাসী হতে চায় রাজ্য সরকার। আর এই আগ্রহের মূল কারণ শিল্পটির নিজস্ব চাহিদা। কারণ, বেশি জমি কিংবা মোটা অঙ্কের লগ্নি এই ব্যবসা শুরুর প্রাথমিক শর্ত নয়। বরং এ ক্ষেত্রে অনেক বেশি জরুরি সেরা মানের মানবসম্পদ এবং তার লাগাতার জোগানের উপযুক্ত পরিকাঠামো। রাজ্যে এই দু’টোই যথেষ্ট পরিমাণে মজুত বলে বরাবরই মনে করে এসেছে শিল্পমহল। আর এ বার এই ‘জাদুকাঠি’র ছোঁয়ায় তথ্য বিশ্লেষণে লগ্নি টানায় দেশের প্রথম সারিতে উঠে আসতে চায় রাজ্যও।
প্রবল প্রতিযোগিতার দুনিয়ায় ব্যবসায় নামা, এমনকী নতুন পণ্য বা পরিষেবা আনার আগেও বাজার-সহ বিভিন্ন বিষয়ে খুঁটিনাটি তথ্য হাতে চায় যে কোনও সংস্থা। কিন্তু শুধু তথ্য জোগাড়ই তো শেষ কথা নয়। বরং জরুরি সেই তথ্য বিশ্লেষণ করে তার থেকে একটি স্পষ্ট ছবি বার করে আনা। যাতে তা ব্যবহার করা যায় ক্রেতাদের পছন্দ-অপছন্দ, ক্র ক্ষমতা ইত্যাদি বুঝতে। আর বরাতের ভিত্তিতে এই বিশ্লেষণের কাজটিই করে পেশাদার অ্যানালিটিক্স সংস্থা।
সংশ্লিষ্ট শিল্পমহল ও রাজ্য সরকার উভয়েই মনে করে, এই ব্যবসার মূল উপাদান হল মানবসম্পদ। এ রাজ্যে যা পর্যাপ্ত পরিমাণে মজুত রয়েছে হাতের কাছেই। সেই সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে তার জোগান নিশ্চিত করতে আছে উপযুক্ত গবেষণা কেন্দ্র ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। রয়েছে ওই সব প্রতিষ্ঠানের গবেষণার পরিকাঠামোও। এ সব ব্যবহার করেই প্রয়োজনীয় তথ্য জোগাড় করে তা বিশ্লেষণে নামতে পারবে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা।
বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে সামিল হয়ে রাজ্য এই শিল্পের জন্য উপযুক্ত পরিকাঠামো গড়তে আগ্রহী। সেই সঙ্গে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও গবেষণা কেন্দ্রের সঙ্গে লগ্নিকারী সংস্থাগুলির যোগসূত্রও তৈরি করবে তারা।
সংশ্লিষ্ট মহলের দাবি, প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে, এই হাবের সুবিধা নিতে পারে খোদ রাজ্য সরকারও। কোনও নির্দিষ্ট নীতি তৈরির আগে বাজারের চাহিদা ও তার বর্তমান হাল-হকিকৎ আগাম জেনে নিতে তথ্য বিশ্লেষণের পরিষেবা ব্যবহার করতে পারে তারা। ঠিক যেমন ভাবে কাজ করে সিঙ্গাপুরের অ্যানালিটিক্স রিসার্চ সেন্টার। বিভিন্ন বরাতদাতা শিল্প সংস্থার হয়ে কাজ করার পাশাপাশি সরকারি নীতি তৈরিতেও বড় ভূমিকা নেয় এই কেন্দ্র।
অনেক বিশেষজ্ঞের মতে আবার রাজারহাটে গড়ে ওঠা আর্থিক হাবের পরিপূরক হয়ে উঠতে পারে এই তথ্য বিশ্লেষণ কেন্দ্র। কারণ, কোনও প্রকল্পে টাকা ঢালার আগে প্রথমেই আর্থিক তথ্য বিশ্লেষণ করাতে চায় একটি সংস্থা। কারণ, ঋণ পেতে বা লগ্নির লাভযোগ্যতা যাচাইয়ে তা একান্ত জরুরি। দুই হাবের (আর্থিক ও অ্যানালিটিকস্) সংযোগ এ ধরনের চাহিদা আরও দ্রুত ও সহজে মেটাতে পারবে বলেই বিশেষজ্ঞদের অভিমত।
বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং (বিপিও) থেকে নলেজ প্রসেস আউটসোর্সিং (কেপিও)-এর গন্তব্যে উত্তীর্ণ হতে এই হাব যে কলকাতাকে অনেকটাই এগিয়ে দেবে, তা বিলক্ষণ জানে রাজ্য। তাই সেই ভাবনার সূত্র ধরে আপাতত বিভিন্ন উপদেষ্টা সংস্থাকে দিয়ে প্রাথমিক রিপোর্ট তৈরির পথে হাঁটছে তারা। |