কাটোয়ায় প্রস্তাবিত তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য সরাসরি জমি কেনার পথ থেকে সরে আসতে চাইছে জাতীয় তাপবিদ্যুৎ কর্পোরেশন (ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কর্পোরেশন বা এনটিপিসি)। মহাকরণ সূত্রে খবর, সম্প্রতি সংস্থা কর্তৃপক্ষ এক চিঠিতে রাজ্য সরকারকে কাটোয়ায় ফের জমি অধিগ্রহণ করে দেওয়ার জন্য আবেদন জানিয়েছে। স্থানীয় মানুষের লিখিত আশ্বাস ও সম্মতি নিয়ে সরকার প্রকল্পের জন্য একলপ্তে জমি অধিগ্রহণ করে দিক, চিঠি পাঠিয়ে সেই দাবিই তুলেছেন এনটিপিসি কর্তৃপক্ষ। সে জন্য সরকার কাটোয়ার জমির যে দাম ঠিক করে দেবে, তা দিতে তাঁরা রাজি বলেও জানিয়েছেন এনটিপিসি কর্তৃপক্ষ। তবে রাজ্যের তরফে এ ব্যাপারে কোনও ইতিবাচক সাড়া এখনও মেলেনি বলে সংস্থা সূত্রের খবর। |
সরাসরি জমি কেনার জন্য মাঠে নেমেও কেন ফের অধিগ্রহণের আর্জি জানিয়ে চিঠি? এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে কোনও মন্তব্য করতে চাননি এনটিপিসি-র চেয়ারম্যান অরূপ রায়চৌধুরী। তবে তিনি বলেছেন, “আমরা কাটোয়ায় তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পটি গড়তে চাই। পশ্চিমবঙ্গ এবং দেশের বিদ্যুৎ শিল্পের স্বার্থে কাটোয়ার প্রকল্পটি আমাদের সবার কাছে বিশেষ ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এর জন্য রাজ্য সরকারের সাহায্যও প্রয়োজন।”
এনটিপিসি সূত্রে খবর, সংস্থার পরিচালন পর্ষদের চাপেই কাটোয়ায় সরাসরি জমি কেনার পথ থেকে সরে আসতে চাইছেন সংস্থা কর্তৃপক্ষ। কারণ পর্ষদ সদস্যরা চাইছেন না, রাজ্য সরকারকে একেবারে বাদ দিয়ে কাটোয়ায় প্রকল্পের জন্য জমি কেনা হোক। পর্ষদের বৈঠকে কাটোয়া প্রকল্প নিয়ে যত বার আলোচনা হয়েছে, সংস্থার উদ্যোগে জমি কেনার বিষয়টিতে অনুমোদন দিতে রাজি হননি সদস্যরা। তাঁদের যুক্তি, সরকারি একটি সংস্থার প্রকল্পের জন্য রাজ্য জমি অধিগ্রহণ করে দেবে, এটাই নিয়ম। বস্তুত, এর আগে এনটিপিসি দেশ জুড়ে যে ২৮টি তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প গড়েছে, প্রতিটি ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকার জমি অধিগ্রহণ করে দিয়েছে। তার মধ্যে এ রাজ্যের ফরাক্কার বিদ্যুৎ প্রকল্পটিও রয়েছে।
বেসরকারি শিল্প বা যৌথ প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হবে না বলে বারেবারেই ঘোষণা করেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। কিন্তু সরকারি কাজের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম রয়েছে। সম্প্রতি ফুরফুরা থেকে ডানকুনি রেল প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া থেকে সরে দাঁড়িয়েছে রেল। রাজ্য সরকারকেই সরাসরি ওই জমি অধিগ্রহণ করে দেওয়ার আবেদন জানিয়ে সম্প্রতি হুগলি জেলা প্রশাসনের কাছে চিঠি দিয়েছেন পূর্ব রেল কর্তৃপক্ষ। তাতে রাজ্য রাজিও হয়েছে। এ ব্যাপারে রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় আগেই বলেছিলেন, “রাজ্য সরকার অনিচ্ছুক চাষিদের জমি জোর করে নেওয়ার বিরুদ্ধে। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে ছাড় তো আছেই। রেলের ব্যাপারটা তার মধ্যেই পড়ে।”
এনটিপিসি-র ব্যাপারে রাজ্যের অবস্থান তা হলে কী? রাজ্য কি এ ক্ষেত্রেও রেলের মতো জমি অধিগ্রহণ করে দেবে? পার্থবাবু বলেছেন, “এনটিপিসি-র ক্ষেত্রে সম্ভব নয়। কারণ আমরা জানতে পেরেছি, কাটোয়ায় অনিচ্ছুক কৃষক রয়েছেন। তাঁরা জমি দিতে চাইছে না। আর রাজ্যের নীতিই হচ্ছে কোথাও জোর করে জমি নেওয়া হবে না। ফলে অধিগ্রহণ সম্ভব নয়।”
প্রশাসনের একাংশের মতে, এনটিপিসি-র প্রকল্পটিকে ঘিরে আখেরে পরীক্ষার মুখে পড়ে গিয়েছে রাজ্যের জমি নীতি। রাজ্যের সিংহভাগ জমি যেখানে ছোট ও মাঝারি চাষিদের হাতে ছড়িয়ে রয়েছে, সেখানে সরকারের জমি অধিগ্রহণ না করার নীতি কতটা বাস্তবসম্মত, তাই নিয়ে গোড়াতেই প্রশ্ন তুলেছিল শিল্পমহল। জমির অভাবে এর মধ্যেই পুরুলিয়ার রঘুনাথপুরে জয় বালাজি, বর্ধমানের জামুড়িয়ায় ভিডিওকন, সালানপুরে ভূষণ স্টিলের মতো বেশ কিছু প্রকল্পের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। অর্ধেক জমি হাতে থাকায় একমাত্র এনটিপিসি-ই নতুন সরকারের কথায় নিজেরা জমি কিনতে এগিয়েছিল। এখন তারাও সরকারকেই জমি অধিগ্রহণ করে দিতে বলছে। অথচ সরকার জানিয়ে দিয়েছে, তা সম্ভব নয়। ফলে এই প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়েও প্রশ্ন উঠে গেল বলেই মনে করছে শিল্পমহল।
এনটিপিসি-র কর্তাদের একাংশ পরিচালন পর্ষদের কর্তাদের ইতিমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছেন, জমি অধিগ্রহণ প্রশ্নে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে পাশে পাওয়া যাবে না। কারণ রাজ্য তাদের ঘোষিত নীতি অনুযায়ী আগেই জানিয়ে দিয়েছে, কাটোয়ায় জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে তারা কোনও সাহায্য করতে পারবে না। এ ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেও এনটিপিসি কর্তারা একই ‘পরামর্শ’ পেয়েছেন বলে পর্ষদ সদস্যদের বলা হয়েছে।
এনটিপিসি-র এক কর্তা বলেন, “এই যুক্তি মানতে চাইছেন না আমাদের পর্ষদের সদস্যরা। তাঁরা রাজ্যের কাছে জমি অধিগ্রহণ করে দেওয়ার ব্যাপারেই আর্জি জানাতে বলেছেন।” রাজ্যকে বাদ দিয়ে এত বড় একটা বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য জমি কেনার ঝুঁকি নিতে পর্ষদ চাইছে না বলেই ওই কর্তা জানাচ্ছেন।
রাজ্যের বিদ্যুৎ কর্তারা জানাচ্ছেন, রাজ্য যে এ ক্ষেত্রে জমি অধিগ্রহণ করবে না, তা আগেই জানিয়ে দিয়েছে। পাশাপাশি জমি মালিকদের সবাই যে সরকারের নির্ধারিত দামে রাজি হয়ে এক লপ্তে জমি দিতে রাজি হয়ে যাবে, সেটা ভাবাও ভুল হবে। কারণ দাম নিয়ে কারও না কারও আপত্তি থাকবেই। আর কোনও একটি পরিবারের আপত্তি থাকলেই অধিগ্রহণে জট তৈরি হতে বাধ্য। তাই এনটিপিসি-র দাবি মেনে রাজ্যের দিক থেকে কোনও সাহায্য করা সম্ভব হবে না।
বর্ধমানের কাটোয়ায় এই ১৬০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ার জন্য ৫৫৬ একর জমি অধিগ্রহণ করেছিল পূর্বতন বামফ্রন্ট সরকার। ওই সময় কাটোয়ায় তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পটি গড়ার কথা ছিল পশ্চিমবঙ্গ বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগমের। পরে অবশ্য রাজ্য সরকার বিদ্যুৎ প্রকল্পটি গড়ার জন্য এনটিপিসি-র সঙ্গেই চুক্তি করে। ঠিক হয়, কাটোয়ায় ১৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের মধ্যে এনটিপিসি ৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ রাজ্যকে দেবে, বাকি ৮০০ মেগাওয়াট তারা বাজারে বিক্রি করবে। ইতিমধ্যে রাজ্যে পালাবদল হয়। নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার কয়েক মাসের মধ্যে বাম আমলে অধিগৃহীত ওই ৫৫৬ একর জমি এনটিপিসি-র হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সংস্থা কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেওয়া হয়, বাকি জমি তাদের সরাসরি কিনে নিতে হবে। টাকা মিটিয়ে দিয়ে অধিগৃহীত ওই জমি হাতে নেওয়ার কথা এনটিপিসি-র। কিন্তু প্রকল্প নিয়ে সংশয়ের কারণেই এনটিপিসি-র কাছ থেকে এখনও সেই টাকা রাজ্য পায়নি।
এনটিপিসি-র জমি নিয়ে সংশয়ের প্রধান কারণ, কাটোয়ার কোশিগ্রাম, শ্রীখণ্ড ও জাজিগ্রাম মৌজায় যে শ’পাঁচেক একর জমি কেনার কথা ভাবা হচ্ছে, তা ছড়িয়ে রয়েছে প্রায় চার হাজার মালিকের হাতে। যাঁদের সামান্য অংশ বেঁকে বসলেই গোটা প্রকল্প ভেস্তে যেতে পারে (সেই দলে অনিচ্ছুক যে রয়েছে, তা পার্থবাবুর কথাতেই স্পষ্ট)। সে ক্ষেত্রে, কোটি কোটি টাকার লগ্নিও জলে যাবে বলে এনটিপিসি কর্তারা মনে করছেন।
|