‘মাতৃসদনে’ গর্ভপাত এবং বন্ধ্যাকরণ করাতে গিয়ে মৃত আশা বর্মনের মৃত্যুর ঘটনায় চিকিৎসায় গাফিলতি ও অভিযুক্তকে আড়াল করার চেষ্টা নিয়ে নানা মহলে ক্ষোভ ক্রমশ বাড়ছে। মৃত্যুর ঘটনার চার দিন পরেও পুরসভার তরফে চিকিৎসা সংক্রান্ত নথিপত্র বাজেয়াপ্ত করা কিংবা চিকিৎসককে জেরার ব্যাপারে কেউ উদ্যোগী না-হওয়ায় মৃতের বাড়ির লোকজন ও পড়শিরাও ক্ষুব্ধ। শুধু তাই নয়, কোনও তদন্তের আগেই পুরসভার অধীন ওই মাতৃসদনের অভিযুক্ত চিকিৎসকের তরফে কোনও ত্রুটি নেই বলে ডেপুটি মেয়র রঞ্জন শীলশর্মা ও মেয়র পারিষদ মৈত্রেয়ী চক্রবর্তী কেন দাবি করেছিলেন তা নিয়েও তদন্তের দাবি উঠেছে। কিন্তু, সোমবার বিকেল পর্যন্ত পুরসভার তরফে কোনও তদন্ত শুরু হয়নি। এমনকী, বিষয়টি নিয়ে পুর ভবনে বৈঠক ডেকে জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিককে দিয়ে তদন্ত করানোর সিদ্ধান্ত হলেও তা জেলা স্বাস্থ্য দফতরকে জানানো হয়নি। পুরসভার মেয়র গঙ্গোত্রী দত্ত বলেন, “ডেপুটি মেয়র বা স্বাস্থ্য বিভাগের মেয়র পারিষদ কেউই আড়াল করার চেষ্টা করেননি। তবে নিরপেক্ষ তদন্তের জন্য জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিককে দায়িত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আশা দেবী মারা গিয়েছেন। তা নিয়ে পুলিশে অভিযোগও জানিয়েছেন পরিবারের লোকেরা। পুলিশ তাদের মতো আইনি ব্যবস্থা নেবেন। মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকের তদন্ত রিপোর্ট পেলে পুরসভার তরফে সেই মতো ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” মাতৃসদনে চিকিৎসা করাতে গিয়ে চিকিৎসকের ভুলে আশাদেবী গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন বলে অভিযোগ। মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রেফার করা হলে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১০ অগস্ট তিনি মারা যান। পুলিশে অভিযোগ জানানো হলে চিকিৎসকের বিরুদ্ধে অনিচ্ছাকৃত খুনের মামলা রুজু করা হয়েছে। উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ময়নাতদন্ত করা হলেও এখনও সেই রিপোর্ট পুলিশের কাছে জমা পড়েনি। মাতৃসদনের চিকিৎসা সংক্রান্ত নথি এ দিন চেয়ে নেন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। পুর কর্তৃপক্ষ জানান, অভিযুক্ত চিকিৎসক ৮ অগস্ট থেকে ছুটিতে রয়েছেন। আজ, মঙ্গলবার তিনি কাজে যোগ দেবেন। এ দিন পুরসভায় গিয়ে ক্ষতিপূরণ এবং পরিবারের একজনকে চাকরির দাবি জানান আশাদেবীর স্বামী উত্তমবাবু, মা দ্রৌপদী বর্মন এবং দিদি মামণি দেবী। অভিযুক্ত চিকিৎসকের শাস্তির দাবিতে এ দিন আলাদা ভাবে পুর কমিশনারকে স্মারকলিপি দেন বাম কাউন্সিলরদের একাংশ, পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি এবং নিখিল বঙ্গ মহিলা সঙ্ঘের সদস্যরা। তারাও ক্ষতিপূরণ এবং পরিবারের একজনকে চাকরির দাবি জানিয়েছেন। চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ ওঠার পরেও কেন যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হল না সেই প্রশ্ন তুলে পুর কমিশনারের সামনে ক্ষোভে ফেটে পড়েন তাঁরা। বাম কাউন্সিলর দিলীপ সিংহ বলেন, “চিকিৎসায় গাফিলতি হয়েছে তা আশা দেবী এবং তাঁর পরিবারের লোকেরা বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি বাঁচতে চেয়েছিলেন। তার পরেও আশাদেবীর জন্য উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা করতে পুর কর্তৃপক্ষের তৎপরতার অভাব দেখা গিয়েছে। মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে আর কোনও খোঁজ খবর করেননি তাঁরা। ঘটনার উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত করে অভিযুক্ত চিকিৎসকের শাস্তির দাবি জানাচ্ছি আমরা।” সিপিএমের মহিলা সমিতির সম্পাদক স্নিগ্ধা হাজরা জানান, ডেপুটি মেয়র এবং স্বাস্থ্য বিভাগের মেয়র পারিষদ চিকিৎসককে আড়াল করতে চেয়েছিলেন। রোগীর পরিবারের সঙ্গে তাঁরা খারাপ আচরণ করেছেন। এর জন্য দুঃখ প্রকাশ করে তাঁদের ক্ষমা চাওয়ার দাবি জানাচ্ছি।” ৪ অগস্ট গর্ভপাত এবং বন্ধ্যাকরণ করানোর পর আশাদেবী অসুস্থ হয়ে পড়েন। রোগিণীকে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রেফার করা হলে চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ তুলে পুলিশে অভিযোগ করেন আশাদেবীর পরিবারের লোকেরা। ডেপুটি মেয়র রঞ্জন শীলশর্মা এবং স্বাস্থ্য বিভাগের মেয়র পারিষদ জানিয়েছিলেন, আশাদেবীর চিকিৎসা ঠিক মতোই হয়েছে। অথচ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে জানা যায় তাঁর অন্ত্রে ফুটো হয়ে গিয়েছে। তা থেকে সংক্রমণ ছড়িয়েছে। এর পরেই মাতৃসদনের চিকিৎসককে আড়াল করার চেষ্টার অভিযোগ ওঠে। ডেপুটি মেয়র এবং স্বাস্থ্য বিভাগের মেয়র পারিষদ জানান, চিকিৎসক তাদের জানিয়েছিলেন চিকিৎসার প্রয়োজনে দ্রুত কিছু পরীক্ষা করানোর প্রয়োজন হতে পারে। মাতৃসদনে সেই পরিকাঠামো নেই বলে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রেফার করেছেন। সেই মতো তারাও জানিয়েছিলেন। এ দিন রঞ্জনবাবু বলেন, “মৃতের পরিবারকে সাহায্য করতেই মাতৃসদনে গিয়েছিলাম। কাউকে আড়াল করার প্রশ্নই নেই। কেউ দোষী প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” |