দশমে মাধ্যমিক তো থাকছেই। তার আগে নবম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষাকে ‘মিনি মাধ্যমিক’-এর চেহারা দিতে চলেছে রাজ্য সরকার। অর্থাৎ মাধ্যমিকের চাপের আগেই মিনি মাধ্যমিকের নতুন চাপ!
নবম শ্রেণিতে মিনি মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রশ্ন করবে মধ্যশিক্ষা পর্ষদ। খাতা দেখবেন অন্য স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা। চলতি শিক্ষাবর্ষেই এই নতুন ব্যবস্থা চালু করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে সোমবার জানান শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু। তাঁর মতে, এর জেরে কোচিং সেন্টার মারফত স্কুলের পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের প্রবণতা কমবে।
যদিও শিক্ষাবিদদের অনেকেই মনে করছেন, এতে এক দিকে পড়ুয়াদের উপরে চাপ বাড়বে, তেমনই রমরমা বাড়বে টিউশনের। তাঁদের অনেকেরই প্রশ্ন, নবম শ্রেণির বিপুল সংখ্যক পড়ুয়ার এই পরীক্ষা নেওয়ার পরিকাঠামো আদৌ আছে তো? প্রবীণ শিক্ষক সুনন্দ সান্যাল বলেন, “মাধ্যমিকের পাশাপাশি প্রায় একই আকারের আরও একটি পরীক্ষা সুষ্ঠু ভাবে নেওয়ার পরিকাঠামো মধ্যশিক্ষা পর্ষদের রয়েছে কি না, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে।”
মধ্যশিক্ষা পর্ষদের প্রশাসক কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায়ের বক্তব্য, এটাকে মাধ্যমিকের ‘মক টেস্ট’ বা প্রস্তুতি পরীক্ষা বলা চলে। এতে পড়ুয়াদের উপকারই হবে বলে মনে করেন তিনি। আর পরিকাঠামো? প্রশাসকের জবাব, “পরিকাঠামো তৈরি করে নিতে হবে। যথাসময়ে ফলপ্রকাশেও কোনও অসুবিধা হবে না।” পর্ষদের আঞ্চলিক দফতরগুলিই ব্যাপারটা দেখবে বলে জানান তিনি।
২০০৫-সালে দেশ জুড়ে আলাপ-আলোচনার পরে জাতীয় স্তরে পাঠ্যক্রমের যে-রূপরেখা (ন্যাশনাল কারিকুলাম ফ্রেমওয়ার্ক) তৈরি হয়েছিল, তার মূল উদ্দেশ্য ছিল পড়ুয়াদের চাপ কমানো। সে-দিকে লক্ষ রেখে দেশের প্রায় সব বোর্ডেই শুধু দশমের পাঠ্যক্রমের ভিত্তিতে দশম শ্রেণির পরীক্ষা এবং কেবল দ্বাদশের পাঠ্যক্রমের ভিত্তিতে দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা চালু হয়। আইসিএসই, সিবিএসই তো বটেই, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদও এই পদ্ধতিতে পরীক্ষা নিতে শুরু করে। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে এ বার নবম এবং একাদশের পরীক্ষা সংশ্লিষ্ট পর্ষদ ও সংসদই নেবে বলে ঠিক করেছে রাজ্য সরকার।
এ দিন মধ্যশিক্ষা পর্ষদ, উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ ও স্কুলশিক্ষা দফতরের কর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন শিক্ষামন্ত্রী। পরে তিনি বলেন, “মূলত টিউশনের প্রভাব রুখতেই এই ব্যবস্থা।” তাঁর মতে, টিউশন নেওয়া মানেই খারাপ নয়। কিন্তু অনেক শিক্ষকই বেশি ছাত্রকে টিউশনে আগ্রহী করে তোলার জন্য স্কুলের প্রশ্ন ফাঁস করে দেন বলে অভিযোগ ওঠে। সেই প্রবণতা ঠেকাতেই এই নতুন ব্যবস্থা চালু করা হচ্ছে বলে জানান শিক্ষামন্ত্রী।
২০১৩-য় যাঁরা একাদশ শ্রেণিতে উঠবেন, তাঁদের একাদশের পরীক্ষার মোট নম্বরের উল্লেখ উচ্চ মাধ্যমিকের মার্কশিটেও থাকবে বলে আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ। নবম শ্রেণির নম্বরের উল্লেখও মাধ্যমিকের মার্কশিটে থাকবে কি না, সেই ব্যাপারে অবশ্য এ দিনের বৈঠকে কোনও আলোচনা হয়নি।
স্কুলের পরীক্ষা দিতে অভ্যস্ত ছাত্রছাত্রীরা সাধারণত বোর্ডের পরীক্ষা দিতে ভয় পায়। শিক্ষার অধিকার আইন চালু হওয়ায় অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ-ফেল উঠে গিয়েছে। তার পরেই হঠাৎ নবম শ্রেণিতে এই ধাঁচের পরীক্ষা দেওয়াটা ছাত্রছাত্রীদের কাছে আদৌ সহজ হবে না বলে মনে করছেন শিক্ষক-শিক্ষিকাদের একটা বড় অংশ। শিক্ষামন্ত্রী অবশ্য বলেন, “এটি বোর্ডের পরীক্ষা নয়। আর পরীক্ষার ফল তো স্কুলই বার করবে।”
বিশিষ্ট শিক্ষকদের অনেকেই কিন্তু পরীক্ষা নেওয়ার এই নতুন পদ্ধতি সম্পর্কে ভিন্ন মত পোষণ করেন। শিক্ষা-গবেষক মর্মর মুখোপাধ্যায় বলেন, “অন্য স্কুলের শিক্ষককে দিয়ে খাতা দেখানোর মানে সংশ্লিষ্ট স্কুলের শিক্ষকের উপরেই অনাস্থা প্রকাশ করা। শিক্ষকদের সন্দেহের চোখে দেখে শিক্ষা ব্যবস্থা চলতে পারে না। তা ছাড়া নবমের পরীক্ষাকেও মাধ্যমিকের চেহারা দেওয়ায় ছাত্রছাত্রীদের উপরে চাপ বাড়বে। বাড়বে জটিলতা। ফলে টিউশনের রমরমাও বাড়বে।”
তাঁর মতে, গোটা পৃথিবী, এমনকী দেশেরও অনেক রাজ্যে যেখানে পড়ুয়াদের উপর থেকে চাপ কমানোর চেষ্টা চলছে, সেখানে এই সিদ্ধান্ত আসলে ‘উল্টো পথে হাঁটা’। প্রবীণ শিক্ষক সুনন্দ সান্যালেরও একই মত। পর্ষদের এক প্রাক্তন সচিব বলেন, “মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রস্তুতি চলে বছরভর। নবমেও যদি পরীক্ষা নিতে হয়, তা হলে একই রকম প্রস্তুতি চালাতে হবে।” সেই কাজটা যে মোটেই সহজ নয়, তা-ও মনে করিয়ে দিয়েছেন তিনি।
পড়ুয়াদের নয়া পরীক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষক-শিক্ষিকাদেরও যে নিত্য পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হবে, তা-ও এ দিন জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ব্রাত্যবাবু বলেন, “শিক্ষক-শিক্ষিকাদের নিজের কাজের মূল্যায়নের পদ্ধতি চালু করতে চলেছি আমরা। কোন শিক্ষকের কত ক্লাস রয়েছে, তিনি তার মধ্যে ক’টি ক্লাস করেছেন, তার নিত্য খতিয়ান দিতে হবে তাঁদের। প্রধান শিক্ষক প্রাথমিক ভাবে সেটা দেখবেন এবং জেলা পরিদর্শকের কাছে সেই রিপোর্ট জমা দেবেন।” এ ভাবে কোন শিক্ষক ঠিক ভাবে পড়ান, কে তা করেন না, সেই সংক্রান্ত তথ্য তাঁদের কাছে থাকবে বলে জানান ব্রাত্যবাবু। তিনি বলেন, “এই সব নথি দেখে পরে রাজ্য সরকার ‘ভাল কাজ করা’ শিক্ষকদের পুরস্কৃত করবে।”
মন্ত্রী এ দিন আর একটি সিদ্ধান্তের কথা জানান। তিনি বলেন, “মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের আগে এ বার টেস্ট পেপার প্রকাশ করবে মধ্যশিক্ষা পর্ষদ ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ। অন্য কেউ টেস্ট পেপার প্রকাশ করলেও তাতে সরকারি স্কুলের প্রশ্ন ছাপা যাবে না।” নিখিলবঙ্গ শিক্ষক সমিতি (এবিটিএ) এতে আপত্তি জানিয়েছে। ওই সংগঠনের এক নেতার কথায়, “পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলে যে-হেতু প্রশ্নের গোপনীয়তা আর থাকে না, তাই সরকারের এই সিদ্ধান্ত যুক্তিহীন।” |