বিধানসভায় পারস্পরিক সৌজন্য, শালীনতা রেখে মানুষের জন্য ঐক্যবদ্ধ ভাবে কাজ করতে শাসক-বিরোধী, দু’পক্ষকেই আবেদন জানালেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিধানসভার প্ল্যাটিনাম জয়ন্তীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সোমবার মমতা বলেন, “বিধানসভা গণতন্ত্রের সব চেয়ে বড় জায়গা। সৌজন্য, নিরপেক্ষতা, শালীনতা বজায় রেখেই মানুষের কথা বলতে হবে।”
অধিবেশন চলাকালীন সাম্প্রতিক কালে একাধিক বার শাসক-বিরোধী সম্পর্কে টানাপোড়েন হয়েছে। কক্ষের মধ্যে কখনও মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি বিরোধী বিধায়ক ‘তির্যক’ মন্তব্য করায় স্পিকার তাঁকে সাময়িক বরখাস্তও করেছেন। কখনও কঙ্কাল-কাণ্ডে অভিযুক্ত সিপিএম বিধায়ক সুশান্ত ঘোষকে লক্ষ করে তৃণমূল শিবিরের ‘অশালীন’ মন্তব্যে তোলপাড় হয়েছে বিধানসভা। এমন সব ঘটনায় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াই যে আদপে ব্যাহত হয়, তা বুঝিয়ে দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী এ দিন বলেন, “মানুষের কথা বেশি করে আলোচনা করতে হবে বিধানসভায়। কাজ করতে গিয়ে কখনও কখনও বিতর্ক হয়। এটা গণতন্ত্রের সৌজন্য। আসুন সকলে মিলে একসঙ্গে কাজ করি।” পঁচাত্তর বছর পূর্তির অনুষ্ঠানে বিধানসভা চত্বরে তখন শাসক-বিরোধী বিধায়কেরা পাশাপাশি বসে। সে কথার উল্লেখ করেই মমতার বক্তব্য, “গণতন্ত্রের পুজো করতে গণতন্ত্রের পীঠস্থানে আমরা সকলে মিলিত হয়েছি।” জনপ্রতিনিধিদের প্রতি তাঁর পরামর্শ, “বিচারের জায়গাটা যেন সব সম্প্রদায়, ভাষা, দিশা, সংস্কৃতির জন্য সমান ভাবে থাকে, তা দেখতে হবে। আসুন গণতন্ত্রে, উন্নয়নে, মানবিকতায়, কাজে আমরা শ্রেষ্ঠ হই।” |
আলাপচারিতায় সূর্য-মমতা। সোমবার বিধানসভায় প্ল্যাটিনাম জুবিলির অনুষ্ঠানে। ছবি: রাজীব বসু। |
সৌজন্য বজায় রাখতে মুখ্যমন্ত্রীর আবেদন বিধানসভার ভবিষ্যৎ অধিবেশনে কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে অবশ্য আশঙ্কা আছে শাসক-বিরোধী, দু’পক্ষেই। বিধানসভা পরিচালনায় গণতান্ত্রিক রীতিনীতি না-মানার অভিযোগে বহু বারই সরব হয়েছে বিরোধীরা। অন্য দিকে, পরিষদীয় মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এ দিনও কারও নাম না-করেই কটাক্ষ করেছেন, “কুৎসা, অপপ্রচারের জায়গা হিসেবে যাঁরা বিধানসভাকে বেছে নেন, তাঁদের বলি বিধানসভার একটা ঐতিহ্য রয়েছে। সেই ঐতিহ্য বজায় রেখেই চলতে হবে।” নাম না-করলেও পার্থবাবুর মন্তব্য যে বিরোধীদের লক্ষ করেই, তা স্পষ্ট। কারণ পার্থবাবুই মন্তব্য করেন, “বলার অনেক কিছু থাকলেও অতিথিদের (বিভিন্ন রাজ্যের স্পিকার-সহ আমন্ত্রিত ব্যক্তিত্ব) সামনে মুখ খুলি না। দেখাতে চাই আমরা এক।”
বস্তুত, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে মানুষের জন্য ‘নিরপেক্ষ’ ভূমিকাই যে জনপ্রতিনিধিদের প্রধান কাজ, সেই ‘বার্তা’ই বারেবারে উঠে এসেছে প্ল্যাটিনাম জয়ন্তীর প্রথম দিনে। উদ্বোধনী-পর্বের পরে বিধানসভা কক্ষে প্রতীকী সভায় ‘সংসদীয় গণতন্ত্রের শক্তিবৃদ্ধি’ বিষয়ক আলোচনাচক্রে স্পিকারের আসনে বসে লোকসভার প্রাক্তন স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “মানুষের প্রয়োজন বাস্তবায়িত করতে না-পারলে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে প্রত্যাহার করার ক্ষমতা মানুষের হাতে থাকা উচিত। তা হলে রাজনীতিক ও রাজনৈতিক দলগুলি গণতান্ত্রিক পথে কাজ করতে বাধ্য হবে।” গণতন্ত্রের অন্যতম ‘পীঠস্থান’ আইনসভায় অনেক সময়ই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়। পরিস্থিতি সামলাতে মার্শাল ডেকে সংশ্লিষ্ট সদস্যকে নিবৃত্ত করতে হয়েছে, এমন নজিরও রয়েছে এ রাজ্যের বিধানসভায়। বছরছয়েক আগে সিঙ্গুরগামী তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতাকে পুলিশ আটকানোর প্রতিবাদে বিধানসভার লবিতে ভাঙচুর করেন তৃণমূল বিধায়কেরা। সেই সব ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করেই সোমনাথবাবু বলেন, “মার্শাল ডেকে সভা সামলাতে হচ্ছে বা সভার সম্পত্তি ও নিরাপত্তা রক্ষা করতে হচ্ছে, এমন ঘটনা বেশ ঘনঘন হচ্ছে। এই পরিস্থিতি বেশ গুরুতর।”
অপরাধীদের রাজনীতিতে অনুপ্রবেশ যে গণতন্ত্রের পক্ষে উদ্বেগের, সে কথা উল্লেখ করে কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী তথা তৃণমূলের সাংসদ সৌগত রায় বলেন, “অর্থ ও পেশিশক্তি এখন নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করছে। অপরাধমূলক কাজ করে আসা মানুষেরাও আইনসভার সদস্য হচ্ছেন, এটা দুর্ভাগ্যজনক।” তবে বিভিন্ন সময়ে প্রশ্নোত্তর-পর্ব চলাকালীন রাজ্য ও কেন্দ্রীয় আইনসভার সদস্যেরা প্রায়শই গোলমাল করে সময় নষ্ট করেন। এই ‘প্রবণতা’ বন্ধ করা জরুরি বলেও মন্তব্য করেন সৌগতবাবু। এরই পাশাপাশি, পুঁজির আক্রমণে গণতন্ত্রের পরিবেশ বিপন্ন হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র। অনেক গভীরে প্রোথিত গণতন্ত্রের শিকড় আঁকড়েই সেই পরিস্থিতি মোকাবিলার কথা বলেন সূর্যবাবু।
প্রথম দিন আনুষ্ঠানিক ‘সৌহার্দ্য’ থাকল যথেষ্টই। আজ, মঙ্গলবার প্ল্যাটিনাম জয়ন্তীর দ্বিতীয় ও শেষ দিন। বিধানসভার অধিবেশনে এই ‘সৌহার্দ্যে’র প্রতিফলন শেষ পর্যন্ত কতটা থাকে, তা-ই দেখার! |