চারপাশের জগৎটা বোঝার সময় এখনও হয়নি ছোট্ট অভিজ্ঞানের।
ভাগ্যিস হয়নি! না হলে সে বুঝতে পারত, তারই বাবাকে খুনের অভিযোগে পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে তার মা।
বোঝার বয়স হয়নি বলেই রবিবার দুপুর থেকে থানা-পুলিশ-লকআপ দেখে, সোমবার আদালতের সওয়াল-জবাবের সাক্ষী থেকে
এবং সব শেষে জেলে ঢুকতে হলেও সে বুঝছে না, আচমকা তার আশপাশের পৃথিবীটা কত বদলে গিয়েছে। মায়ের কোলে কোলেই বাড়ির নিরাপদ ও চেনা আশ্রয় ছেড়ে বদলে যাওয়া পরিবেশে খাপ খাওয়াতে হচ্ছে বছর দেড়েকের ওই শিশুকে।
এ দিন ভিড়ে ঠাসা আদালতে যখন চলছে তারই বাবা জয়দেব মণ্ডলের মৃত্যু-মামলার সওয়াল-জবাব, তখন সে মায়ের কোলে চুপ করে বসে থেকেছে। বিচারক এজলাস ছেড়ে যাওয়ার পর মায়ের কোল থেকে নেমে আদালতের ভিতরে খানিকক্ষণ শিশুসুলভ চপলতায় ছুটে বেড়িয়েছে সে। আদালতের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশকর্মীদের সঙ্গে লুকোচুরিও খেলেছে। আর দিনের শেষে মা নিবেদিতা নিয়োগী মণ্ডলের কোলে চেপেই সোমবার তাকে যেতে হয়েছে ঝাড়গ্রাম সাব-জেলে। মায়ের যে জেল হাজত হয়েছে আদালতে! বাবার বাড়ি ও মামা বাড়ি থেকে কেউ দায়িত্ব নিতে চাননি অভিজ্ঞানের। তার বাবা, ঝাড়গ্রাম শহরের রঘুনাথপুর এলাকার বাসিন্দা জয়দেব মণ্ডলের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয় শনিবার গভীর রাতে। ঘুমন্ত স্বামীর মুখে নিবেদিতা বিষ ঢেলে দেন বলে অভিযোগ। ওই রাতেই ঝাড়গ্রাম জেলা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকেরা জয়দেবকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। জয়দেবের বাবা কৃষ্ণপদ মণ্ডলের দায়ের করা খুনের অভিযোগের ভিত্তিতে রবিবার দুপুরে নিবেদিতাকে রঘুনাথপুরের বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। রবিবার একমাত্র ছেলেকে সঙ্গে নিয়েই থানায় যান নিবেদিতা। |
নিবেদিতা এ দিন বার কয়েক ছেলেকে কোলে নিয়ে খুনসুটি করা ছাড়া বাকি সময়টা চুপচাপ থেকেছেন। কারও সঙ্গে কথা বলেননি বছর সাতাশের অভিযুক্ত এই স্কুল শিক্ষিকা। কেবলমাত্র একবার আদালতে ঢোকার আগে পরিচিত এক সাংবাদিককে দেখতে পেয়ে ছেলের বেবি-ফুডে মেশানোর জন্য গরম জল চেয়েছিলেন। আইনি বাধায় তা অবশ্য দেওয়া যায়নি।
নাতির দায়িত্ব নিলেন না কেন জানতে চাইলে কৃষ্ণপদবাবু বলেন, “আমার স্ত্রী নেই। নাতিকে নিয়ে গেলে দেখাশোনা করবে কে?” বাড়ির অমতে বিয়ে করায় নিবেদিতার সঙ্গে আগেই সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন তাঁর বাবা দেবীপ্রসাদ নিয়োগীও। ফলে ওই বাড়িতেও ঠাঁই হবে না অভিজ্ঞানের।
এ দিন ছেলে কোলেই নিবেদিতাকে ঝাড়গ্রাম এসিজেএম আদালতে হাজির করানো হয়। চেহারায় ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। এখনও সিঁথিতে সিঁদুর, দু’হাতে শাঁখা-পলা। অভিযুক্তপক্ষের আইনজীবী তপন সিংহ আদালতে দাবি করেন, ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৪৩৭ ধারা মতে, শিশুসন্তান সমেত কোনও অসহায় মহিলার জামিন মঞ্জুর করার ক্ষেত্রে আদালতের বিশেষ এক্তিয়ার রয়েছে। তপনবাবুর দাবি, “অভিজ্ঞানের দায়িত্ব এড়ানোর জন্যই কৃষ্ণপদবাবু বউমার বিরুদ্ধে মিথ্যা খুনের অভিযোগ দায়ের করেছেন। তা ছাড়া, নিবেদিতাই প্রথম জয়দেবের বন্ধুবান্ধবদের মাঝরাতে ফোন করে স্বামীর অসুস্থতার খবর দেন। এর থেকে প্রমাণ হয়, তিনি স্বামীকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন।”
সরকারি কৌঁসুলি কণিষ্ক বসু জামিনের বিরোধিতা করেন। সব শুনে বিচারক প্রিয়জিৎ চট্টোপাধ্যায় জামিনের আবেদন খারিজ করে শিশু-সহ নিবেদিতাকে ১৪ দিনের জন্য জেল হাজতে রাখার নির্দেশ দেন। এ দিনই পুলিশের আবেদনক্রমে ১৬৪ ধারা অনুযায়ী জয়দেবের দুই বন্ধু অরুণ বিশুই ও অশোক ভট্টাচার্যের গোপন জবানবন্দি নথিভুক্ত করেন ঝাড়গ্রামের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সুপর্ণা রায়। |