১৯৪৭-এর ১৫ অগস্ট ভাগ হয়ে গিয়েছিল জামির লেনের এক অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান পরিবার।
তার পর কাঁটাতারের দু’পাশে রচিত হল দুই ইতিহাস। লিখছেন
ডেরেক ও’ব্রায়েন |
প্রত্যেক বছরই স্বাধীনতা দিবস এলেই আমার নেলি বেলা বিশ্বাসের কথা মনে পড়ে। আমার বাবার ঠাকুমা। বাঙালি পরিবারের মেয়ে। তিনি ১৯৬৯ সালে যখন মারা যান, তখন আমি স্কুলের নিচু ক্লাসের ছাত্র। তবুও, তাঁকে খুব ভাল মনে আছে আমার আমাদের তিন ভাইকে তিনি বাংলা বলতে শিখিয়েছিলেন।
ছোটবেলায় মনে হত, নেলি বেলা ও’ব্রায়েন এক আইরিশ ভদ্রলোককে বিয়ে করে তাঁর নতুন পদবি হয়েছিল ও’ব্রায়েন যেন এক চলমান ইতিহাস। তিনিই ভারতমাতা ১৯৪৭ সালের অগস্টে যখন ভারত ভেঙে দুটো দেশ তৈরি হল, দেশটার ঠাসবুনোট সমাজ ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল তখন তিনি নিঃশব্দে চোখের জল ফেলেছিলেন।
নেলি বেলা ১৯৪৭ সালের অগস্টে কেঁদেছিলেন। ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৯ পর্যন্ত প্রত্যেক দিন, যত দিন তিনি বেঁচে ছিলেন, প্রত্যেকটা দিন তাঁর চোখে জল দেখেছিল। তিনি প্যাট্রিকের জন্য কাঁদতেন। তাঁর প্রথম পুত্র, তাঁর প্রিয়তম পুত্র। প্যাট্রিক লাহৌরে থেকে গিয়েছিলেন।
দেশভাগের গল্প আসলে হিন্দু আর মুসলমানদের গল্প। তারাই এই মহাকাব্যের মুখ্য চরিত্র। খ্রিস্টানদের ভূমিকা সামান্যই ছিল। আমাদের মতো অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরা ভারতীয় খ্রিস্টানদের মধ্যেও সংখ্যায় অতি নগণ্য। দেশভাগের মহাকাব্যে তাদের বড় জোর মৃত সৈনিকের ভূমিকায় অভিনয়ের অধিকার ছিল। অথচ, এই দেশভাগই আমাদের পরিবারের গল্পটাকে চির কালের মতো বদলে দিয়েছিল। নেলি বেলা ও’ব্রায়েনের তিন ছেলে আমার ঠাকুরদা তাঁদের এক জন। বড় ছেলে প্যাট্রিক ছিলেন উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের গভর্নর স্যর ওলাফ ক্যারো-র প্রাইভেট সেক্রেটারি। কর্মসূত্রে চিনি লাহৌর আর পেশোয়ারের বাসিন্দা ছিলেন। ও’ব্রায়েন পরিবারের বাকিরা বেশির ভাগই কলকাতায় থাকতেন। |
ধর্মের অধিকার। কলকাতার সেন্ট পলস ক্যাথিড্রালে বড়দিনের প্রার্থনা। ২০১১। |
এক দিন হঠাৎই প্যাট্রিক ও’ব্রায়েনের পরিবার পাকিস্তানের নাগরিক হয়ে গেল। এই নতুন নাগরিকত্বের মানে কী, তা ভাল করে বোঝার সুযোগ পাওয়ার আগেই। কয়েক মাসের মধ্যেই ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ বাধল। প্যাট্রিকের দুই মেয়ে দু’জনের স্বামীই এয়ার ফোর্সের বিমানচালক। তাঁদের এক জন রয়ে গেলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীতে, আর অন্য জন যোগ দিলেন পাকিস্তানি সেনায়।
পাঠক! নেলি বেলার মনের অবস্থাটা কল্পনা করতে পারেন? অথবা তাঁর দুই নাতনির? তাঁরা রাতের পর রাত জেগে থাকতেন ভাবতেন, তাঁর স্বামী ঘরে ফিরবেন তো, অথবা তাঁর বোনের স্বামী? ভাবতেন, মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেও যে দুই বিমানচালক পরস্পরের অভিন্নহৃদয় বন্ধু ছিলেন, সহযোদ্ধা ছিলেন আজ আকাশের অনন্ত শূন্যতায় তাঁরা কি পরস্পরকে শত্রু হিসেবেই দেখছেন, একে অপরের মৃত্যুর ছক সাজাচ্ছেন?
সৌভাগ্যক্রমে, দু’জনের কেউই সেই যুদ্ধে নিহত হননি। কিন্তু, তাঁদের মধ্যে মাথা তুলেছিল অনিবার্য কাঁটাতার। বাবার সঙ্গে মেয়ের, বোনের সঙ্গে বোনের, মামাতো-পিসতুতো ভাইবোনের, আমার ভারতীয় ঠাকুরদা আর তাঁর পাকিস্তানি ভাইয়ের, নেলি বেলার সঙ্গে তাঁর বড় ছেলে প্যাট্রিকের যোগসূত্র ছিন্ন হয়ে গেল।
আমি, আমার ভাইরা, একটা সম্পূর্ণ অন্য পরিবেশে বড় হয়ে উঠলাম। আমরা যে পাড়াটায় থাকতাম, সেখানের রাস্তাটা এক মুসলমানের নামে জামির লেন। পাড়ার অধিকাংশ বাসিন্দাই অবশ্য মধ্যবিত্ত হিন্দু বাঙালি, আমরাই ছিলাম একমাত্র খ্রিস্টান পরিবার। শুধু এইটুকুর জন্যই স্বাধীন ভারতকে আমার চমৎকার লাগে। আমরা যে বাড়িটায় থাকতাম, সেটা বানিয়েছিলেন নেলি বেলা, ১৯৩৮ সালে। তিনি অল্প বয়সে বিধবা হয়েছিলেন। তিনি ডাক্তার ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের প্রথম কয়েক জন মহিলা ডাক্তারের মধ্যে তিনি এক জন।
১৯৪৬ সালে যখন কলকাতায় দাঙ্গা হল, তখন তিনি শিয়ালদা থেকে বালিগঞ্জ অবধি রেললাইন ধরে হাঁটতেন। আহত মানুষ দেখলে তাঁদের শুশ্রুষা করতেন। হিন্দু বা মুসলমান, কোনও পক্ষই তাঁকে কখনও আক্রমণ করেনি। তাঁর গলায় ঝোলানো স্টেথোস্কোপ ছিল তাঁর অভিজ্ঞান; প্রতি পদক্ষেপ বহন করত তাঁর দৃঢ় প্রতিজ্ঞার স্বাক্ষর তাঁকে থামানো যাবে না, তাঁকে লক্ষ্যচ্যুত করা যাবে না।
১৯৬৯ সালে ৭৮ বছর বয়সে তিনি মারা যান। তাঁর মৃত্যুশয্যায় তাঁকে ঘিরে ছিল তাঁর সন্তানসন্ততি, পৌত্র-প্রপৌত্রের দল। গোটা জামির লেন ভেঙে পড়েছিল তাঁকে শেষ বিদায় জানাতে। তিনি শুধু আমার বাবার ঠাকুমা ছিলেন না, গোটা পাড়ার ছিলেন। তাঁর শেষযাত্রায় শুধু এক জনই এসে পৌঁছতে পারেননি প্যাট্রিক ও’ব্রায়েন। তেইশ বছর তাঁরা পরস্পরকে দেখেননি।
১৯৮৪ সাল। আমার ভাই অ্যান্ডি তখন এক পত্রিকার ক্রীড়া সাংবাদিক। হকির চ্যাম্পিয়নস ট্রফির রিপোর্ট করতে সে করাচি গেল। সে মন স্থির করে গিয়েছিল হারিয়ে যাওয়া ও’ব্রায়েনদের সে খুঁজে বের করবেই। অ্যান্ডি তাঁদের খুঁজে পেয়েছিল। প্যাট্রিক তত দিনে মারা গিয়েছেন, কিন্তু পরিবারের বাকিরা অ্যান্ডিকে একেবারে জড়িয়ে ধরল। অ্যান্ডি দেখল, তারা এখনও ‘বাড়ি’ বলতে কলকাতার জামির লেনের বাড়িটাকেই বোঝে। সেই পরিবারের ছেলেমেয়েদের কাছেও নেলি বেলা ও’ব্রায়েন অসম্ভব জীবন্ত এক চরিত্র, এক কিংবদন্তি।
কিন্তু, একটা অন্য খবরও ছিল। আমার বাবার প্রজন্মের অনেকেই, এবং আমাদের প্রজন্মের সব্বাই, ধর্মান্তরিত হয়েছেন। তাঁরা এখন মুসলমান। ধর্মীয় সংখ্যালঘু হয়ে পাকিস্তানে টিকে থাকা খুব কঠিন হয়ে পড়েছিল ওদের জন্য।
অ্যান্ডি তাদের অনেক গল্প নিয়ে ভারতে ফিরল। করাচি আর লাহৌরের মুসলমান অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের গোষ্ঠীর গল্প ঠিক করে বললে, মুসলমান আইরিশ-বাঙালি পরিবারের গল্প। অদ্ভুত সব গল্প। আমরা সেই গল্প শুনতে শুনতে খেতাম, নিঃশব্দে। আমি পাকিস্তানের ও’ব্রায়েনদের গল্প শুনতাম, আর নিজের কথা ভাবতাম এই দেশে আমার চার্চে যাওয়ার স্বাধীনতা, নিজের ধর্মীয় পরিচয় বজায় রাখার স্বাধীনতা, নিজের মতো বাঁচার স্বাধীনতা, নিজে যা, তা-ই থাকতে পারার স্বাধীনতা। আমার দেশ সংখ্যালঘুদের যে অধিকার দিয়েছে, আমি সেগুলোর কথা ভাবতাম। ভারতীয় হিসেবে আমি কখনও এত গর্ব বোধ করিনি।
নিজের মনেই ভাবি আচ্ছা, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক আন্দোলনে আমি যে ভাবে জড়িয়ে পড়তে পেরেছিলাম, পাকিস্তানে থাকা ও’ব্রায়েনরা কি তেমন স্বাধীন ভাবে কোনও মূলধারার রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে পারবে? তারা আমার মতো নিয়মিত পার্লামেন্টে যাওয়ার সুযোগ পাবে? যত ভাবি, ততই নিজেকে ভাগ্যবান মনে হয়। আমি নেলি বেলা বিশ্বাসকে পেয়েছিলাম তিনি আমাদের বাংলা শিখতে উৎসাহ দিয়েছিলেন, পাড়ার সরস্বতী পুজোয় আর পাঁচটা বাঙালি ছেলের মতোই যোগ দিতে শিখিয়েছিলেন। তিনি আমাদের এই দেশের বৃহত্তর সমাজের সঙ্গে গেঁথে দিয়েছিলেন। আমি ভাগ্যবান, কারণ বাংলা বা ভারত আমায় এই অধিকারগুলো দেওয়ার বিনিময়ে আমার কাছে কোনও অন্যায় দাবি করেনি।
আমি ভাগ্যবান, কারণ আমি ভারতের নেলি-র কাছে বড় হয়েছিলাম আমি নেলির ভারতে বড় হয়েছিলাম।
|
কুইজমাস্টার ও রাজ্যসভায় তৃণমূল কংগ্রেসের চিফ হুইফ। |