|
|
|
|
প্রবন্ধ ১... |
গণতন্ত্র কেন মূল্যবান, ভারত তার নিদর্শন |
তাই গরিবকে চটজলদি তার প্রাপ্য পাইয়ে দিতে গণতন্ত্রকে লঙ্ঘন করা চলে না। লিখছেন
অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ও স্বাতী ভট্টাচার্য।
প্রথম পর্ব |
ভারত স্বাধীন হওয়ার পর ৬৪ বছর পরেও, গণতন্ত্র ভারতকে কী দিয়েছে, সে প্রশ্নটার তীক্ষ্ণতা কমেনি। এর কোনও একটা উত্তর হয় না ঠিকই, তবু কিছু ইঙ্গিত এমন পাওয়া যায় যা খুব অর্থবহ। যেমন, ভারতে যাঁরা প্রধান শিল্পপতি, যাঁদের অধিকাংশই উচ্চবর্ণ হিন্দু, তাঁদের যদি প্রশ্ন করা হয় যে কাকে তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর আসনে দেখতে চান, অধিকাংশই বলবেন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কিংবা বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের নাম। এঁরা দু’জনেই ‘ও বি সি’ নীতীশ কুর্মি, নরেন্দ্র মোদী তেলি। ভারত যখন স্বাধীন হয়েছিল, তখন এমন ‘নিচু’ জাতের কেউ দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যোগ্য বলে বিত্তবান, উচ্চবর্ণ মানুষ মনে করবেন, তা অকল্পনীয় ছিল। আজ তা সম্ভব হয়েছে গণতন্ত্রের জন্যেই। আগে যে সব সম্ভাবনা ওঠার আগেই বাতিল হয়ে যেত, এখন সহজেই গ্রহণ করা হচ্ছে, তা গণতন্ত্র কাজ করছে বলেই।
দলিতদের নেতৃত্ব যেমন ‘অসম্ভব’ থেকে ‘আকাঙ্ক্ষিত’ হয়ে উঠেছে, তেমনই ঘটেছে মেয়েদের ক্ষেত্রেও। রাজস্থান এবং পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছু গ্রাম পঞ্চায়েতে দেখা গিয়েছে, যেখানে পরপর দু’বার প্রধান ছিলেন মহিলা, সেখানে মহিলাদের নেতৃত্বে মানুষের আস্থা অনেক বেশি। এই সব পঞ্চায়েতে আসন সংরক্ষিত না থাকলেও মেয়েদের ভোটে লড়াই করে জিতে আসার সম্ভাবনা যথেষ্ট। অন্তত যেখানে কখনও মহিলা প্রধান ছিলেন না, সেই সব গ্রামের চেয়ে অনেক বেশি। তাই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে, বিত্তবান উচ্চবর্ণ-প্রভাবিত শিল্পজগতেই হোক, আর দরিদ্র-প্রধান গ্রামসমাজই হোক, নেহাত কেজো নিয়মগুলো মেনে গেলেও গণতন্ত্র সম্ভব-অসম্ভবের নকশায়, বৈষম্যের চেনা ছবিতে অনেকখানি পরিবর্তন আনতে পারে। সব পরিবর্তন যে ভাল তা বলা চলে না, অনেকে বলবেন মোদীর সাফল্য গণতন্ত্রের ভয়াবহ দিকটাই দেখায়। কিন্তু পঞ্চাশ বছর আগে যে এটা হতে পারত না, এবং হতে পারত না আমাদের বন্ধ মনের জন্য, তা নিঃসন্দেহে বলা চলে। |
|
সেরা সম্পদ। দলিত-জনজাতি পরিবারে শিশুদের স্কুলে যাওয়াই এখন স্বাভাবিক। ছবি: অনির্বাণ সেন |
গণতন্ত্র থেকে আমাদের অপ্রাপ্তির তালিকা অনেক বড় ঠিকই। কিন্তু গণতন্ত্র কী করতে পারে, করতে পেরেছে, তা-ও চিন্তা করা দরকার। আজ থেকে দশ বছর আগেও সব ছেলেমেয়ের স্কুলে একসঙ্গে মিড ডে মিল খাওয়া নিয়ে নানা আপত্তি উঠত, আজ আর সেগুলো শোনা যায় না। ভারতের কয়েক হাজার বছরের ইতিহাসে হয়তো এই প্রথম একটি প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে, যারা কখনও অস্পৃশ্যতা মানেনি, জল-অচল বলে কোনও জাতকে চিনতে শেখেনি। সেই সঙ্গে শিক্ষার প্রসার ঘটেছে, দলিত-জনজাতির শিশুরা প্রায় সকলেই স্কুলে যাচ্ছে। সেখানে তারা আদৌ কিছু শিখছে কি না, কে ক’বছর স্কুলে পড়ছে, তা নিয়ে অসন্তোষ থাকতেই পারে। কিন্তু হাড়ি-ডোম-চামার ঘরের ছেলেমেয়েদের স্কুলে যাওয়াই যে এখন ‘স্বাভাবিক’ বলে মনে হচ্ছে, সেটা খুব কম কথা নয়।
আমরা বলছি না যে গণতন্ত্র ছাড়া এ সব পরিবর্তন কোনও ভাবেই আসতে পারত না। কিন্তু এটা বোধহয় বলা যায় যে গণতন্ত্রে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ ভেদাভেদ বেশি দিন চলতে পারে না।
এটাও লক্ষ করা দরকার যে, গণতান্ত্রিক প্রশাসন ব্যবস্থার যে সব নিয়ম-কানুন রয়েছে, যে সব প্রতিষ্ঠান তার পরিচালনা করে, এত বছরে ভারতে সেগুলির নৈতিক গ্রহণযোগ্যতা কমেনি, বরং বেড়েছে। আগে ভোটে রিগিং হচ্ছে বলে মাতামাতি হত, তাই গণতন্ত্রের একটা প্রধান শর্তই মার খেয়ে যাচ্ছিল। নির্বাচন কমিশন ভোটদানের বৈধতা বাড়াতে পেরেছে। যার জেতার কথা ছিল না সে জিতেছে, এমন অভিযোগ আজ সহজে কেউ বিশ্বাস করবে না। ১৯৯২ সালে ৭৩তম সংবিধান সংশোধনের পর পঞ্চায়েত ব্যবস্থাও একটা মর্যাদা পেয়েছে। পঞ্চায়েতের কাজ নিয়ে মানুষের যতই ক্ষোভ থাক, পঞ্চায়েত নির্বাচনে ৭০-৮০ শতাংশ মানুষ ভোট দিচ্ছেন। গ্রামসভায় লোক যতই কম আসুক, সেখানেই গ্রামের উন্নয়নের পরিকল্পনা গৃহীত হচ্ছে। এই সব গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের নানা অকর্মণ্যতা-অক্ষমতা সত্ত্বেও এগুলোকে এড়িয়ে গিয়ে কেউ কাজ করতে পারছেন না।
|
গণতন্ত্র কী পারে |
তা বলে গণতন্ত্র নিয়ে আমাদের ক্ষোভও কম নেই। বিপুল দারিদ্রের দিকে তাকিয়ে মনে হয়, কী পেলাম? গণতন্ত্র মানে যদি হয় মানুষের শাসন তা হলে যে দেশের অধিকাংশ মানুষ গরিব, সে দেশে গরিবের রুটি-কাপড়-বাসস্থান জুটল না কেন? যে দেশের অর্ধেক ভোটার মহিলা সেখানে মেয়েরা কেন অপুষ্টি, রক্তাল্পতায় ভোগে? কেন শিক্ষাহীন, শ্রমসর্বস্ব মানুষদের অধিকাংশ দলিত কিংবা আদিবাসী? যাদের যা প্রাপ্য তাদের যদি তা না-ই দেওয়া গেল, তা হলে কী লাভ হল গণতন্ত্রে?
এই বিরক্তি, ক্ষোভ থেকে সম্প্রতি আন্দোলনের একটা ধারা লক্ষ করা গিয়েছে, যেখানে রাষ্ট্রের উপর চাপ সৃষ্টি করতে ব্যবহার করা হচ্ছে আদালতকে। খাদ্যের অধিকার আন্দোলনের সময়ে আমরা দেখেছি, কাকে কী দিতে হবে, কতটা দিতে হবে, তা-ও ঠিক করে দিয়েছিল আদালত। আবার প্রাপ্য জিনিস বা পরিষেবা যদি প্রার্থীর কাছে না পৌঁছয়, তার জন্য রাষ্ট্রকে ধমক দিতেও রয়েছে আদালত। এই ভাবধারার আন্দোলনই বলছে যে, জাতীয় উপদেষ্টা কমিটির মতো একটি অনির্বাচিত কমিটির সুপারিশে কিছু অনির্বাচিত লোক নিয়ে তৈরি হবে লোকপাল, যা দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত সরকারি কর্মীদের দ্রুত এবং কঠোর শাস্তি দেবে। এমন আপাদমস্তক অগণতান্ত্রিক একটি প্রাতিষ্ঠানিক পরিকাঠামো তৈরি করার কথা যাঁরা বলছেন, তাঁরা স্পষ্টতই গণতন্ত্রের উপর ভরসা করতে পারছেন না। তাঁরা বলছেন না যে, ‘কোথায় কী দুর্নীতি হচ্ছে আমরা সব প্রকাশ করে দেব, তার পর মানুষই দুর্নীতিগ্রস্ত নেতা-আমলাদের ব্যবস্থা করবেন, সে ভোটের বাক্সেই হোক আর রাস্তায় নেমে আন্দোলন করেই হোক।’ বরং অণ্ণা হজারে, জঁ দ্রেজ, অরুণা রায়ের মতো নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা ‘বৃহত্তর স্বার্থে’ নতুন নতুন ‘অধিকার’ তৈরি করে, খানিকটা গণতন্ত্র ডিঙিয়ে, মানুষের কাছে প্রাপ্য পৌঁছে দিতে চাইছেন।
এই কাজ অনেকগুলি দিক থেকে গণতন্ত্রের বিরোধী। এক, বিচারব্যবস্থা দিয়ে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থাকে প্রভাবিত করছেন নাগরিক আন্দোলনের নেতারা। কৃষি মন্ত্রী শরদ পওয়ার বলেছিলেন যে, খাদ্যের অধিকার বাস্তবে কার্যকর করার ক্ষমতা ভারত সরকারের নেই। তাঁর কথায় কিছু যুক্তি নিশ্চয়ই ছিল, কিন্তু তা নিয়ে বিতর্ক হল না এই অগণতান্ত্রিক চাপের নীতির জন্যই। মানুষের চাহিদা অনুসারে মানুষের প্রতিনিধি নীতি তৈরি করবেন, গণতন্ত্রের এই ‘ক্লাসিকাল’ ধারণা থেকে সরে যাচ্ছেন নেতারা। দুই, নির্বাচন প্রক্রিয়ায় না গিয়ে তাঁরা নিজেদের মতকে ‘জনমত’ বলে দাবি করছেন, এবং দিল্লিতে ক্রমাগত রাজনৈতিক নেতাদের প্রভাবিত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। তিন, দরিদ্র নাগরিকের অধিকারের উপর জোর দিতে গিয়ে তাঁরা হয়তো খেয়াল করছেন না যে নিরপেক্ষ বিচার পাবার অধিকার গণতন্ত্রে একেবারে প্রাথমিক অধিকার। বিশেষত সরকারি ব্যবস্থার নিচুতলায় কর্মীরাও নাগরিক, এবং তাঁদের নানা অনাচার সত্ত্বেও নাগরিক হিসেবে তাঁদের উপযুক্ত বিচার পাওয়ার অধিকার আছে। দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে ‘জনস্বার্থে’ চটজলদি শাস্তি দিতে হবে, এই ধারণা উত্তর কোরিয়ায় মানানসই, ভারতে নয়।
|
গণতন্ত্র কী পারে না |
গণতন্ত্র যা পারে, তা হল মানুষের দাবি নিয়ে সরব হতে। সরকারি হাসপাতালে কম দামে ওষুধ চাই, রেশনে এ পি এল গ্রাহকদেরও গম দিতে হবে, অমুক জনগোষ্ঠীকে ‘জনজাতি’ বলে গণনা করতে হবে, রাত-বিরেতে গ্রামে তল্লাশি চলবে না, এই চাহিদাগুলিকে গণতন্ত্র ব্যক্ত করে। অনেকের চাহিদাকে একটি নির্দিষ্ট দাবিতে পরিণত করা, এবং তা পাওয়ার জন্য রাষ্ট্রের উপর চাপ সৃষ্টি করা এগুলো গণতন্ত্রের মৌলিক কাজ। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি মেনে রাষ্ট্র যে গরিবের জন্য কিছু প্রাপ্য নির্দিষ্ট করেছে, ভারতে গণতন্ত্র কাজ করছে বলেই হয়তো তা সম্ভব হয়েছে।
সমস্যা হল, একজন গরিব মানুষ যখন তাঁর প্রাপ্য দাবি করেন, সে রেশন দোকানেই হোক বা সরকারি হাসপাতালেই হোক, তখন রাষ্ট্রের প্রতিনিধি খুব সহজেই তাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিতে পারে। হবে না, আজ নেই, কখনও পাওয়া যায় না, অমুকের সার্টিফিকেট নিয়ে আসুন এমন নানা অজুহাতের জাল বোনা হয়। এর প্রতিকার কী? গণতন্ত্রে এটার প্রতিকার করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে প্রাথমিক ভাবে আদালতকে। তা এই আশঙ্কা থেকে যে, একজনের প্রতি বিচার করতে গিয়ে অন্য একজনের প্রতি অন্যায় না হয়ে যায়। ‘জনস্বার্থ’ প্রতিষ্ঠা করার যে গণ-উত্তেজনা, তা থেকে দূরে থেকে ঠাণ্ডা মাথায় বিচার করবে আদালত। গণতন্ত্রের নামে যেমন আদালতের উপর চাপ সৃষ্টি করা চলে না, তেমনই এমন কোনও বিচারব্যবস্থার সুপারিশও করা চলে না, যেখানে বিচারকই তদন্ত করবেন।
সেই সঙ্গে, ‘প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র’ দিয়ে সরকারি কর্মীর উপর চাপ সৃষ্টি করা, তাকে শাস্তি দেওয়াটাকেও সমর্থন করা চলে না। অণ্ণা হজারে সংগঠিত ‘গ্রাম সভা’ কিংবা অরুণা রায় সংগঠিত ‘জন সুনওয়াই’ যে পঞ্চায়েতের দুর্নীতি, অকর্মণ্যতা প্রকাশ করেছে, সেটা অবশ্যই প্রশংসার যোগ্য। কিন্তু অভিযুক্ত প্রধানকে বা সরকারি কর্মীকে বরখাস্ত করে দেওয়াটা ভোটের মাধ্যমে বা আদালতের মাধ্যমেই সম্ভব। স্বনির্বাচিত জনগণের নেতারা জনগণের নামে কারও হাতে মাথা কাটবেন, এটা গণতন্ত্রের পদ্ধতি নয়। এটা নীতিগত সমস্যা। তা ছাড়া বাস্তব সমস্যাও রয়েছে। ‘সংগঠিত প্রতিবাদ’ তৈরি করা কত কঠিন, তা নাগরিক সংগঠন মাত্রই জানেন। একত্র হবার সুযোগ পেলেই তা কাজে লাগিয়ে মানুষ প্রাপ্য আদায় করবেন, এই ধারণা যদি ঠিক হত তা হলে গ্রাম সভা, স্কুল শিক্ষা কমিটি, রেশন দোকান পরিদর্শন কমিটি, এমন অজস্র তৃণমূল স্তরের জনমঞ্চ এত দিনে গ্রামীণ প্রশাসনের মুখটাই বদলে দিত। এত দিনে বোঝা গিয়েছে যে, যোগদান নিশ্চিত করার প্রক্রিয়াও জটিল, শ্রমসাধ্য, ব্যয়সাধ্য। সে অমনি হবার নয়। অরুণা রায়, অণ্ণা হজারে যা করেছেন, আটপৌরে জনজীবনে গণতন্ত্র তা করে না। তাই তাঁরা ‘দৃষ্টান্ত’ হলেও ‘মডেল’ নন।
তা হলে শূন্য রেশন ব্যাগ-হাতে গরিব লোকেদের কী হবে? গণতন্ত্র তাঁদের প্রাপ্য লাভ নিশ্চিত করার জন্য কী করতে পারে? (চলবে)
|
শ্রীবন্দ্যোপাধ্যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি-তে অর্থনীতির শিক্ষক। |
|
|
|
|
|