কয়েক দিন পরেই ইদ। তাই আনন্দের সীমা ছিল না বারিক মোল্লার পরিবারে। নুন আনতে পান্তা ফুরনোর সংসার। তবু বছরে একটা দিন স্ত্রী ছেলেমেয়েরা আনন্দ করবে না! তাই ছেলেমেয়েরা যখন নতুন জামাকাপড়ের জন্য বায়না ধরেছিল তখন কোথা থেকে কী হবে ভাবেননি বারিক। বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন ভ্যানরিকশাটা নিয়ে। সারাদিনের রোজগারের টাকায় বাড়ির সবার জন্যই জামাকাপড় কিনে নিয়ে ফিরছিলেন। চোখে ভেসে উঠছিল স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের হাসিমুখখানা। কিন্তু বাড়ি ফিরে তাঁর জীবন যে এ ভাবে এলোমেলো হয়ে যাবে তা স্বপ্নেও ভাবেননি বারিক। স্ত্রী ও এক ছেলের মৃতদেহ যে ভাবে আঁকড়ে ধরেছিলেন তাতে তাঁকে সামলাতে পারছিলেন না প্রতিবেশীরা। শনিবারের সকাল আর দুপুর যেন যেন বারিকের জীবনটাই বদলে দিয়েছে। রঙিন জামাকাপড়গুলো বুকে আঁকড়ে ধরে খালি একটা কথাই বলছেন, “এ গুলো পরে ওরা আনন্দ করবে ভেবেছিলাম। কিন্তু ওরা আমাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেল।” |
উত্তর ২৪ পরগনার দেগঙ্গার বেড়াচাঁপা-১ পঞ্চায়েতে টাকি রোডের পাশ দিয়ে একটু এগোলেই দক্ষিণ কাউকেপাড়া গ্রাম। এখানেই স্ত্রী ও ছয় ছেলেমেয়ে নিয়ে বাস পেশায় ভ্যানচালক বারিক মোল্লার। দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। বাক দু’জনের মধ্যে রেশমা নবম ও রহিমা ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। দুই ছেলের মধ্যে জুলফিকার চতুর্থ শ্রেণিতে ও ছোট আবুজোর সবে অঙ্গনওয়াড়ি ছেড়েছে। অভাবের সংসারেও স্বামী-স্ত্রী ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে সচেষ্ট ছিলেন। সামনেই ইদ। শুক্রবার ছেলেমেয়েরা বায়না ধরে নতুন জামাকাপড়ের। তাই শনিবার টাকার জোগাড়ে ভোর থেকে ভ্যানরিকশা নিয়ে বেরিয়ে যান বারিক। সারা সকাল ভ্যান চালিয়ে রোজগারের টাকায় জামাকাপড় কিনে দুপুর নাগাদ বাড়ি ফিরছিলেন।
বাবা বাড়ি ফিরলে একসঙ্গে খাবে। তাই তাড়াতাড়ি স্নান করতে দুপুর পুকুরে নেমেছিল জুলফিকার। সঙ্গে ছিল ভাই আবুজোরও। কিন্তু আগে থেকে পুকুরে ছিঁড়ে পড়েছিল বিদ্যুতের তার। জলে নেমে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয় দু’জনেই। তাদের সঙ্গে স্নান করতে নেমে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হন আরও দু’জন। এ দিকে ছেলেরা ফিরছে না দেখে ও হইচই শুনে মা সাহিদা বিবি ছেলেদের উদ্ধার করতে পুকুরে ঝাঁপ দিলে তড়িদাহত হন তিনিও। স্থানীয় বাসিন্দারা বিদ্যুৎ সংযোগ ছিন্ন করে সকলকে উদ্ধার করলেও দেখা যায় জুলফিকার ও সাহিদা মারা গিয়েছেন। বাকিদের সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
বারিক মোল্লার পরিবারের ঘটনায় গোটা গ্রামটাই যেন চুপ মেরে গিয়েছে। ইদের আনন্দ কে যেন শুষে নিয়েছে। রবিবার গ্রামে গিয়ে দেখা গেল কারও ঘরেই উনুন জ্বলেনি। স্ত্রী ও সন্তান হারানোর বেদনা গোটা গ্রামটাকেই ভীষণভাবে ছুঁয়ে গিয়েছে। |