দিল্লি থেকে প্রায় ৬৫ কিলোমিটার দূরে সুশীল কুমারের গ্রামবাপরোলা। বৃষ্টির জলে ভরে থাকা খানা-খন্দ পেরিয়ে রবিবার দুপুরে সুশীলের বাড়িতে পৌঁছে দেখলাম, গোটা গ্রামটাই উঠে এসেছে ওদের উঠোনে। শুধু কি ওদের গ্রাম? আশপাশের গ্রাম থেকেও চলে এসেছেন অনেকে। কারও হাতে তেরঙা পতাকা। কেউ বোঝাই করে এনেছেন পটকা।
ততক্ষণে সুশীল পৌঁছে গিয়েছেন সেমিফাইনালে। আর ওঁর বাবা, এমটিএনএল-এর গাড়ির চালক দিওয়ান সিংহ-ও উত্তেজনায় ক্রমশ এগিয়ে গিয়েছেন টিভির দিকে। মা কমলা দেবী আবার প্রবল টেনশনে। ভয়ে দেখছেনই না টিভিযদি ছেলে হেরে যায়! বারবার উঠে চলে যাচ্ছেন ড্রয়িং রুমের বাইরে। পরক্ষণেই ফিরে আসছেন টিভির ঘরের তুমুল চিৎকার শুনে। তবে দাদু-সহ পরিবারের অন্য সদস্যরা চোখ ফেরাচ্ছেন না টিভি থেকে। সুশীল সেই সময় পয়েন্ট তুলছেন একটা-একটা করে। দেখতে দেখতে সেমিফাইনালে কাজাখ প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারিয়ে ফাইনালে পৌঁছে গেলেন। বাবা দিওয়ান সিংহের আত্মবিশ্বাসও ক্রমশ বাড়তে বাড়তে আকাশ ছুঁয়ে ফেলেছে। বলছিলেন, “আমি ১১০ শতাংশ নিশ্চিত। সোনাই আনবে সুশীল।” বাড়ির বাইরে তখন পটকার কানফাটানো শব্দ। তেরঙা হাতে লাফাচ্ছে বাচ্চা থেকে বুড়োরা-ও। |
সস্ত্রীক সুশীল কুমার। রবিবার রুপো জয়ের লন্ডনে। ছবি: উৎপল সরকার |
লম্বা প্রতীক্ষার পর শুরু হবে জাপানি প্রতিপক্ষের সঙ্গে সোনা জয়ের লড়াই। সেই সময় দিওয়ান সিংহ হারিয়ে গিয়েছিলেন সুশীলের ছোটবেলায়। “আমিও এক সময় কুস্তি করতাম। পরে যখন চাকরির দরকার পড়ল, বাধ্য হয়ে গাড়ি চালাতে শুরু করলাম। এই জন্য আমি সুশীলের ছোটবেলা থেকেই চাইতাম ও বড় কুস্তিগীর হোক। এখন আমার স্বপ্ন সুশীলের হাত ধরেই সফল হচ্ছে,” বলছিলেন দিওয়ান। সেই সঙ্গে জানালেন সুশীলের সফল হওয়ার কারণও। দিওয়ানের কথায়, “সুশীল কখনও নিজের বড়াই করে না। কাউকে ঘৃণা করে না। সবাইকে সম্মান করে। নিজের ছেলে বলে বলছি না, এই সব কারণেই ও পদক জিতছে।”
দেখতে দেখতে ঘড়ির কাঁটা পৌঁছে গেল সাড়ে ছ’টায়। ড্রইংরুমে সবার চোখ আটকে টিভির পর্দায়। কিন্তু এই লড়াইয়ে আর জিতলেন না সুশীল। দু’টো রাউন্ডেই জাপানি ইয়োনেমিৎসু ছিনিয়ে নিয়ে গেলেন সোনা। গোটা গ্রাম তখন এতটাই নিস্তব্ধ যে নিঃশ্বাসের শব্দও যেন কানে আসছে। শোকের কালো ছায়ায় ঢেকে গিয়েছে সুশীলের বাড়িও। অদ্ভুত ভাবে কয়েক মিনিট পরই অন্ধকারে ঢেকে গেল বাপরোলা গ্রাম। লোডশেডিং। প্রতীকী? হঠাৎ সংবিৎ ফিরল দিওয়ান সিংহ-কমলা দেবী-সহ গ্রামবাসীরআমাদের ছেলেটা সোনা জেতেনি তো কী হয়েছে, রুপো তো ঘরে আনছে। সেই সঙ্গে পরপর দুই অলিম্পিকে ব্যক্তিগত ইভেন্টে দু’টো পদক! এ কৃতিত্ব তো কোনও ভারতীয়র নেই। বাপরোলা গ্রাম তো এখন ইতিহাসের পাতায়!
শুরু হয়ে গেল উৎসব। সুশীলদের বাড়িতে অর্ডার দিয়ে ৫০ কেজি লাড্ডু আনানো হয়েছিল। সেগুলো বিতরণ করতে লাগলেন সুশীলের বাবা-মা। ঢাক-ঢোল নিয়ে হাজির দু’-তিন হাজার লোক। নাচ-গান, পটকার আওয়াজ। গ্রামের সব রাস্তায় মানুষের ঢল। আটকে পড়েছে গাড়ি। দিল্লির উপকণ্ঠে তিন মাস আগেই যেন দীপাবলি। আনন্দে ভিজে এসেছে মা কমলা দেবীর গলা, “ছ’মাস ও বাড়ির বাইরে। এ বার তো মন কাঁদছে। কবে যে দেখতে পাব।” সুশীল ফিরছেন মঙ্গলবার রাত্রেই। সুশীলের স্ত্রী সাবি লন্ডন থেকে ফোন করলেন কমলা দেবীকে। বললেন, “আমার জন্মদিনের উপহার পেয়ে গিয়েছি। আমি ভীষণ খুশি।” জানা গেল, ১৫ অগস্ট স্বাধীনতা দিবসেই জন্মদিন সাবি-র। বাবার গলায় আবার জমা হয়েছে অভিমান, “ছেলেটা যদি আরও শক্তিশালী প্রতিপক্ষের সঙ্গে লড়ে প্র্যাক্টিসের সুযোগ পেত! সোনা জিতেই ফিরত। এখানে তো অনেকেই লড়তে চায় না। কেউ হেরে যাবে বলে লড়ে না। কেউ আবার ঈর্ষায়। ফেডারেশন বা ক্রীড়ামন্ত্রক থেকে খুব বেশি সাহায্য পায়নি।” তার পর যোগ করছেন, “জাতীয় পতাকা বাহক হওয়াটা অবশ্যই গর্বের। তবে এর জন্য লন্ডনে আগে থাকতেই হাজির ছিল সুশীল। শেষ বেলায় আর এক বার বেলারুশে অনুশীলন করতে যেতে পারল না। তবে রুপোতেও আমি খুশি। আমার তরফ থেকে সব দেশবাসীকে এই রুপো উৎসর্গ করছি।” তিনি মনে করছেন, যোগেশ্বর দত্ত এবং সুশীল অলিম্পিক থেকে পদক পেলেন নিজেদের কৃতিত্বেই। |
দেশ |
|
|
|
মোট |
যুক্তরাষ্ট্র |
৪৬
|
২৯ |
২৯ |
১০৪ |
চিন |
৩৮ |
২৭
|
২২ |
৮৭ |
ব্রিটেন |
২৯
|
১৭ |
১৯
|
৬৫ |
রাশিয়া |
২৪
|
২৫
|
৩৩ |
৮২ |
দক্ষিণ কোরিয়া |
১৩ |
৮ |
৭ |
২৮ |
ভারত ( ৫৫ তম) |
০
|
২ |
৪ |
৬ |
|
এই সবের মধ্যেই হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী ভূপিন্দর সিংহ হুডা ফোন করেন সুশীলের বাড়িতে। দিওয়ান সিংহকে তিনি জানালেন, সুশীলের জন্য দেড় কোটি টাকার পুরস্কারের কথা। সেই সঙ্গে অ্যাকাডেমি গড়ার জন্য জমিও দিতে চান। রেলকর্মী সুশীলের জন্য ৭৫ লক্ষ টাকার পুরস্কার ঘোষণা করলেন রেলমন্ত্রী মুকুল রায়ও। কেন্দ্রীয় ক্রীড়ামন্ত্রী অজয় মাকেন ফের জানিয়েছেন, অলিম্পিক পদকজয়ীদের সাই-তে অফিসার পদে প্রশিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করার। বাকি অলিম্পিয়ানদেরও সাইতে নিয়োগ করার কথা বলছেন তিনি। তবে পুরস্কারে নয়, সুশীলের বাড়ি রবিবার মজে ছিল রুপো জয়ের আনন্দে। চার বছর আগে বেজিং থেকে ব্রোঞ্জ। এ বার লন্ডন থেকে রুপো। তা হলে চার বছর পর রিও দে জেনিরো থেকে কি সোনা?
বাড়ির ড্রইংরুমে ঝোলানো শয়ে-শয়ে পদক। সেই ছোট্টবেলা থেকে যেগুলো জিতে চলেছেন। রয়েছে সব বড় টুর্নামেন্টে লড়াইয়ের ছবি। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি আব্দুল কালামের হাত থেকে অর্জুন পুরস্কার নেওয়ার ছবিও আছে সেখানে। লন্ডন অলিম্পিকের রুপো গলায় ঝুলিয়ে ছবিও অচিরেই স্থান পাবে সেখানে। কিন্তু গর্বিত দিওয়ান সিংহের কথা শুনে মনে হল, ড্রইংরুমে আরও জায়গা করে রাখতে হবে। চার বছর পর রিও অলিম্পিকের জন্য। দিওয়ান বলছিলেন, “এই রুপোতেই শেষ নয়। রিও থেকে সুশীল সোনাই আনবে। শুধু সমকক্ষ কুস্তিগীরদের সঙ্গে আরও বেশি অনুশীলন করতে হবে।” অন্যান্য আত্মীয়স্বজন থেকে প্রতিবেশীসবার গলাতেই এক সুর। ফেরার রাস্তা ধরে মনে হল, চার বছর পর আবার হয়তো আসতে হবে এই গ্রামে। সে দিনটা তো সব ভারতবাসীর কাছেই গর্বের হবে।
|
লন্ডন অলিম্পিক থেকে ভারতের দ্বিতীয় রুপো জিতে তুমি আমাদের গর্বিত করেছ। আমরা তোমার দায়বদ্ধতা, সংকল্প, পরিশ্রম দেখে গর্বিত। ওয়েল ডান সুশীল।
সচিন তেন্ডুলকর |
আমরা তোমার জন্য গর্বিত। তুমি আমাদের চ্যাম্পিয়ন।
মেরি কম |
ভবিষ্যতে আরও সুযোগ আসবে। সুশীল, তুমি এখনও আমাদের কাছে চ্যাম্পিয়ন।
মহেন্দ্র সিংহ ধোনি |
প্রথম ভারতীয় হিসাবে দুটো অলিম্পিকে পদক জিতল সুশীল। আমার কাছে ওই আসল ভারতীয় নায়ক।
গীত শেঠি |
আমার কাছে সুশীলের রুপো জেতাটা সোনা জেতার সামিল। কারণ, এই প্রথম কোনও ভারতীয় পরপর দুই অলিম্পিকে ব্যক্তিগত ইভেন্টে পদক পেল।
সাইনা নেহওয়াল |
|