ভাবলে গায়ে এখনও কাঁটা দিচ্ছে! অলিম্পিকের অভিজ্ঞতা যে এতটা বিস্ময়কর হতে পারে, ধারণা ছিল না। ক’টা দিনই বা ছিলাম? কিন্তু ওই কয়েকটা দিনে যা দেখেছি, শুনেছি, জেনেছি, গোটা জীবনেও অনেকের অত অভিজ্ঞতা হয় না। সব লিখতে গেলে একটা উপন্যাস হয়ে যাবে। অল্প কথায় সারি।
গেমস ভিলেজে যখন চেক ইন করেছিলাম, ভারত থেকে তখনও কেউ আসেনি। বাকি ঘরগুলো তখন অন্ধকার থাকত। তার পর দেখলাম, আস্তে আস্তে ভিলেজের অন্যান্য অ্যাপার্টমেন্টে লোক আসছে। বিদেশি পতাকা ঝোলানো হচ্ছে বারান্দায়। আলাদা আলাদা ‘জোন’ তৈরি হয়ে গেল। কোথাও বোর্ডে লেখা থাকত ‘টিম এস্পানা’। কোথাও ‘টিম ইতালিয়া।’ দেখতাম আর অবাক হতাম। বাকিদের দেখে কিছুটা ঈর্ষাও হত। ইতালি টিমকে দেখতাম, আর্মানির ট্র্যাকসুট পরে দৌড়চ্ছে। সেখানে নিজেদের অবস্থা ভেবে মনটা একটু তো খারাপ হতই।
সুশীল কুমার দিয়ে শুরু করি। অলিম্পিকের শেষ দিন ও ভারতকে রুপো দিল। ও যে পদক পাবে, আমি কিন্তু জানতাম। ভিলেজে ওর সঙ্গে বিশেষ মেলামেশার সুযোগ হয়নি। শুধু উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের দিন আলাপ হয়েছিল। অনুষ্ঠানের আগে ইগনেস তিরকে, আমি, সুশীল আড্ডা মারছিলাম। সুশীল এমনিতে শান্তশিষ্ট ছেলে। মুখে একটা হাসি লেগেই আছে। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল হাসিটা লোক দেখানো। ভিতরের সুশীল যেন অন্য কেউ। একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে সব সময় ডুবে রয়েছে। আশ্চর্যের ব্যাপার, ওকে নিয়ে তেমন আলোচনা শুনিনি ভিলেজে। কিন্তু সুশীলের হাসিটাই বলে দিত, ও যে পদক জিতবে সেটা ও জানে! |
আমি নিজে শ্যুটার বলে ভারতের শ্যুটারদের সঙ্গেই ঘনিষ্ঠতা বেশি ছিল। বিশেষ করে অভিনব বিন্দ্রার সঙ্গে। মনে আছে, গগন নারঙ্গ সে দিন ব্রোঞ্জ জিতেছে। তুমুল হইচই। ওকে ঘিরে মিডিয়ার এত ধাক্কাধাক্কি চলছিল যে, রয়্যাল আর্টিলারি ব্যারাকে গগনের কাছে ঘেঁষতেই পারিনি। বাইরে তখন আমার জন্য দাঁড়িয়ে বিন্দ্রা। একটু আগেই ছিটকে গিয়েছে। ফাইনাল রাউন্ডে যেতে পারেনি। মন খারাপ কাটাবে বলে নারঙ্গের শু্যটিং দেখতে চেয়েছিল বিন্দ্রা। সেটাও হয়নি ভিড়ের চাপে। ঢুকতেই পারেনি। যাই হোক, সাক্ষাৎকারের ঝামেলা মিটিয়ে ওকে খুঁজতে গিয়ে দেখি, বাসস্ট্যান্ডে একা দাঁড়িয়ে। একটার পর একটা বাস ছাড়ছে। শুধু আমার সঙ্গে ফিরবে বলে। ওর জন্য ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। বেজিংয়ে ওর হাতটা শুধু একবার ছোঁয়ার জন্য হাজার-হাজার লোকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কিন্তু লন্ডনে সে দিন ওর পাশে কেউ ছিল না। ডিনারে নারঙ্গকে অভিনন্দন জানিয়ে যখন বিন্দ্রার ঘরে ঢুকছি, তখন ও ব্যাগ গোছাচ্ছে। একবার মুখ তুলে শুধু বলল, “ট্রিগার টেপার সময় এত চিৎকার হবে ভাবিনি। ওখানেই সব গোলমাল হয়ে গেল!” মনে মনে তখনই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, বন্ধুর জন্য কিছু অন্তত আমাকে করতে হবে।
বিন্দ্রা ছিটকে যাওয়ায় বড় একটা ধাক্কা খেয়েছিলাম। মনের অবস্থা ঠিক একই হয়েছিল হকি টিমের দুর্দশা দেখে। ভিলেজে অন্য প্লেয়ারদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হলে ‘হাই হ্যালো’-র বেশি এগোয় না। কিন্তু হকি টিমটা যত হারছিল, তত যেন গুটিয়ে যাচ্ছিল। সব সময় একটা বিমর্ষ ভাব। কেমন আছো, জিজ্ঞেস করলে মাথা হেলিয়ে চলে যেত। ভরত ছেত্রীর সঙ্গে আমার আলাপ আজকের নয়। কিন্তু ওখানে গিয়ে ওর সঙ্গে একটা কথাও হয়নি। ও সে ভাবে বলতে চায়নি। আমিও আর খোঁচাতে যাইনি। শুধু দেখতাম, একা একা একটা কোন বেছে বসে আছে।
বরং টেনিসে সে সব দেখিনি। অলিম্পিকে সানিয়ারাও বিশেষ এগোতে পারেনি, কিন্তু তা নিয়ে হা-হুতাশ শুনিনি। মহেশের সঙ্গে মিত্তলদের ডিনারে গিয়েছিলাম। হারকে মেনে নিয়েছিল মহেশ। যেন ও জানত, এটাই হবে। লিয়েন্ডারের সঙ্গে ওর সম্পর্ক নিয়ে যে ক’জন খোঁচাখুঁচি করেছে, সবাইকে সযত্নে এড়িয়ে গিয়েছে মহেশ। আর লিয়েন্ডারকে তো দেখিইনি ভিলেজে। বোধহয় হোটেল থাকত। যেমন দেখা হয়নি সাইনা নেহওয়ালের সঙ্গে। টিভিতেও ওর খেলা দেখতে পারিনি।
বিন্দ্রা চলে যাওয়ার পর আমার মন ভাল রাখার দায়িত্ব নিয়েছিল বিজয়কুমার। ও রকম অদ্ভুত ছেলে খুব কম আছে। কথায় কথায় ইয়ার্কি। বাথরুমে ঢুকেছি, ও বাইরে থেকে ছিটকিনি আটকে দিয়েছে! ভিতরে আটকে পড়েই তখন ওকে ভয় দেখাতাম। বলতাম, মেরে তোর হাত ভেঙে দেব। আমার আর ওর একই দিনে ম্যাচ ছিল। পদক জিততে পারিনি বলে মন খারাপ। আলমারিতে বন্দুক রাখছি, ও তখন বন্দুক বার করছে। বললাম, আমি পারিনি, তুই করে দেখা। একগাল হেসে বেরিয়ে গেল আর পিস্তল শ্যুটিংয়ে ফিরল রুপো নিয়ে! বিজয় এ রকমই। সব সময় ফাজলামি মারছে, কিন্তু শ্যুটিংয়ের সময় ওর মনোঃসংযোগ নষ্ট করা শিবের অসাধ্য!
তবু বিজয় নয়, ভিলেজে সবচেয়ে আকর্ষণীয় চরিত্র আমার মনে হয়ছে বিজেন্দ্রকে। নিজের খ্যাতিটা ভাল সামলায়। আগে শুনতাম ও ফ্ল্যামবয়েন্ট, কিন্তু লন্ডনে ওকে মনে হয়েছে অসম্ভব পরিণত। মেরি কম আবার ভীষণ ভদ্র। মেরির ব্রোঞ্জ জেতা বা বিজেন্দ্রর হেরে যাওয়া কোনওটাই দেখা হয়নি। কেন যে বিজেন্দ্র জিততে পারল না, জানি না। দেখা যাক, পরের বার কী করে।
সব শেষে আসি নিজের কথায়। কলকাতায় ফিরে শুনছি, অলিম্পিকে যাওয়ার সুযোগ খুব বেশি বাঙালির হয়নি। সে দিক থেকে দেখতে গেলে, আমি ভাগ্যবান তো বটেই। পদক জিততে পারিনি। রিও-তেও পারব কি না জানি না। শুধু একটা ছবি আমার চোখে ভাসে। পদক হাতছাড়া হওয়ায় মন খারাপ, দাঁড়িয়ে আছি, আচমকা দেশ-বিদেশের সমস্ত শ্যুটাররা এসে জড়িয়ে ধরতে লাগল। পদক না জিতেও এমন ভালবাসা পাব ভাবিনি। যেমন কানে বাজে আইওএ প্রেসিডেন্টের কথা, ‘বেটা তুনে দিল জিত লিয়া।’
প্রথম বার অলিম্পিকে এসে এই প্রাপ্তিই বা কম কী?
|