টেমসের তীরে কুস্তিতে ‘কিস্তিমাত’
বেশি ওজনের প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে
প্র্যাক্টিস করেই শক্তি বাড়িয়েছে

ছর নয় আগে যখন নিউ ইয়র্কে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ছেলেটাকে দেখি, তখন ওর বয়স কত হবে? বছর কুড়ি। ও লড়তে নেমেছিল ৬০ কেজি বিভাগে। আমার ছিল ১২০। কিন্তু তখন থেকেই ওর একটা জিনিস আমার দারুণ লাগত। জেতার মানসিকতা। উল্টো দিকে কে আছে, সে সব পাত্তা না দিয়ে জেতার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়া।
সেই ছেলেটাই আজকের সুশীল কুমার। যে আমাদের অল্পের জন্য অলিম্পিক সোনাটা দিতে পারল না। কিন্তু এই বিশ্বাসটা দিয়ে গেল যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে লড়ার জন্য আমরা তৈরি। সুশীলের ফাইনালটা যখন শুরু হয়, আমি দিল্লির এক টিভি স্টুডিওয়ে বসে। ওর লড়াইটা দেখতে দেখতে কেমন একটা সন্দেহ হচ্ছিল। তাই ফাইনালটা শেষ হতেই লন্ডনে রাজ সিংহকে ফোন করি, মানে আমাদের বক্সিং সংস্থার কর্ণধার। উনিই আমাকে জানালেন, সেমিফাইনালে ঘাড়ে চোট পেয়ে গিয়েছিল সুশীল। তার উপর অসুস্থতা তো ছিলই। সব মিলিয়ে নিজের সেরাটা দিতে পারল না ফাইনালে।
ধুন্ধুমার। লন্ডনে সুশীলের কুস্তি। ছবি: উৎপল সরকার
সুশীল আমার সঙ্গে ভারতীয় টিমে ছিল, আমি ওর সঙ্গে প্র্যাক্টিসও করেছি অনেক বার। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, ওর সবচেয়ে বড় প্লাস পয়েন্ট হল শক্তি। যেন ভীমের শক্তি আছে ওর গায়ে। সেমিফাইনালে যে ভাবে প্রতিপক্ষকে মাটি থেকে তুলে ফেলল, তাতেই শক্তির বহরটা মালুম পড়ে। শক্তি বাড়ানোর জন্য আখড়ায় সুশীল নিয়মিত ওর চেয়ে বেশি ওজনের পালোয়ানদের সঙ্গে লড়েছে। পাশাপাশি গতি বাড়ানোর জন্য লড়েছে কম ওজনের পালোয়ানদের সঙ্গেও। ওজন তোলা আর অন্যান্য ব্যায়াম তো ছিলই।
গত ন’বছরে সুশীল অসম্ভব উন্নতি করেছে। দুর্বলতাগুলোও কমিয়ে এনেছে। তা বলে কি ও নিখুঁত কুস্তিগির? সেটা কিন্তু বলতে পারছি না। সুশীলের একটা দুর্বলতার কথা আমি জানি। ও মাঝে মাঝে খুব আক্রমণাত্মক হয়ে পড়ে। যেটা ট্যাকটিক্যালি ভুল একটা মুভ। তখনই কিন্তু সুশীল ঝামেলায় পড়ে যায়। এ দিন সুশীলের লড়াইগুলো প্রথম থেকেই খুব মন দিয়ে দেখেছি। সেমিফাইনালে ও কাজাখস্তানের বিরুদ্ধে একই ভুল করেছিল। অহেতুক তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে নিজের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিল। আর তখনই বিপক্ষ পয়েন্ট তুলে নেয়। সুশীল তো সেমিফাইনালের শেষ রাউন্ডে ০-৩ পয়েন্টে পিছিয়ে পড়েছিল। সেই অবস্থা থেকে ওকে জিতিয়ে দেয় ওর নাছোড়বান্দা মনোভাবটা। ফাইনালে সেটা হয়নি। দুর্বল হয়ে যাওয়ার ফলে নিজের শক্তির পুরোমাত্রায় ব্যবহার করতে পারল না সুশীল।
ফুলকপি কান
অধিকাংশ কুস্তিগিরের কান পরিণত বয়সে পৌঁছে ফুলকপির মতো ফোলা-ফোলা হয়ে যায় বলে কুস্তিগিরদের ডাকনাম চালু হয়ে গিয়েছে ‘কলিফ্লাওয়ার ইয়ারস’। সুশীল কুমার বা যোগেশ্বর দত্ত ব্যতিক্রম নন। বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হল, ১২-১৩ বছর বয়স থেকে কুস্তি লড়ার জন্য প্রতিপক্ষের কাঁধের উপর শক্তি প্রয়োগ করতে হয়। এতে কানের উপরও চাপ পড়ে। কাঁধের মধ্যে দিয়ে যে সব স্নায়ু মাথায় গেছে তার কাজে ব্যাঘাত ঘটে। তা ছাড়া কানের উপর ক্রমাগত চাপ পড়তে থাকায়, কানের কার্টিলেজে রক্তবাহের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পুষ্টি পৌঁছতে পারে না। ফলে কার্টিলেজ টিসুর গঠন নষ্ট হয়ে যায়। আর কানের লতির বিভিন্ন অংশ ফুলে ওঠে।

সুশীল অলিম্পিক যাওয়ার আগে কিন্তু ওকে নিয়ে বেশ কথা উঠেছিল। অনেকেই বলাবলি করছিল, অলিম্পিকের আগে ওর প্রস্তুতি ঠিকঠাক হয়নি। এমনও বলা হয়েছিল, বিয়ের পর সুশীলের ফোকাস কুস্তি থেকে কিছুটা সরে গিয়েছে। আমাকে তখন অনেকেই প্রশ্ন করেছিল, বিয়েটা কি ও একটু তাড়াতাড়ি করে ফেলল? আমি পরিষ্কার বলেছিলাম, বিয়ের সঙ্গে পারফরম্যান্সের সম্পর্ক নেই। দেশে তো অনেক অবিবাহিত কুস্তিগির আছে, তারা কি দারুণ কিছু করে দেখাচ্ছে? আমি শুধু বলেছিলাম, সুশীলকে নিজের ট্রেনিং সূচি পুরোপুরি মেনে চলতে হবে। তা হলেই সাফল্য আসবে।
আমি আর সুশীল দু’জনেই কুস্তিগির পরিবারের ছেলে। আমার বাবা, বোন দু’জনেই ভাল কুস্তিগির। আমরা দু’জনেই হরিয়ানার ছেলে। এখন অবশ্য দিল্লিতে থাকি। সুশীলের বিয়েতে গিয়েছিলাম। ওকে খুব কাছ থেকেই চিনি। মানুষ সুশীল কিন্তু ম্যাটের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা সুশীলের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। মানুষ সুশীল নিপাট ভালমানুষ, লাজুক, ভদ্র। আর কুস্তিগির সুশীল হল হিংস্র, ভয়ঙ্কর এক লড়াইয়ের যন্ত্র। ভারতের কিন্তু এই দ্বিতীয় সুশীলকেই প্রয়োজন।
অলিম্পিকে যাওয়ার আগেও সুশীলের সঙ্গে কথা হয়েছিল। ও তখনই বলেছিল, পুরো প্রস্তুতিটাই দারুণ হয়েছে। বলে গিয়েছিল, আরও ভাল ফল করে ফিরবে। কথা রাখল সুশীল।

লন্ডনের প্রস্তুতি কী ভাবে
শারীরিক: দিনে আট ঘণ্টা অনুশীলন। থাকে জগিং, স্ট্রেচিং, যোগাসন, ডন-বৈঠক, জিমে ওজন তোলা ও দড়ি বেয়ে ওঠা। নিয়মিত কুস্তি চর্চা বা ম্যাট ওয়ার্ক। গ্রাউন্ড ওয়ার্কে ফুটবল, বাস্কেটবল, হ্যান্ডবল বা ভলিবল খেলা। দিন শুরু ভোর সাড়ে চারটেয়। রাত দশটার মধ্যে ঘুম।
ট্যাকটিক্যাল: লন্ডনে নিজের বিভাগের প্রত্যেক কুস্তিগিরকে নিয়ে আলাদা গবেষণা। ল্যাপটপে প্রত্যেকের লড়াইয়ের ভিডিও দেখে শক্তি ও দুর্বলতা বিশ্লেষণ। আক্রমণ ও রক্ষণের ধরন বুঝে তাদের বিরুদ্ধে নিজের রণকৌশল তৈরি।
বিদেশে ট্রেনিং: যুক্তরাষ্ট্র ও বেলারুশে।
ডায়েট: দিনে আড়াই থেকে তিন কিলো মোষের দুধ। বাড়িতে তৈরি সাদা মাখন দু’শো গ্রাম। মাসে ১০-১৫ কিলো কাঠ বাদাম। দিনে দু’বার ফলের রস। রাতে বাদাম-দুধ। প্রাতরাশে দুধ-কর্নফ্লেক্স, দু’পিস পাউরুটি, মাখন, ফল ও ফলের রস, কাঠ বাদাম। দুপুরে ২-৩ টি রুটি, সব্জি বা পনির, ডাল, স্যালাড, ফল ও দই। বিকালে ফলের রস। রাতেও প্রায় একই ধরনের খাওয়া। সঙ্গে প্রেটিন সাপ্লিমেন্ট ও মাল্টিভিটামিন। নিমামিষাশী। পেঁয়াজ-রসুনও খান না।
মানসিকতা: একাগ্রতা বাড়াতে ধ্যান ও যোগ। ইতিবাচক চিন্তা। অলিম্পিকের তিন মাস আগে থেকে যৌন সংসর্গ ত্যাগ।




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.