টেমসপাড়ে কুস্তির ম্যাটে স্বর্ণশিখর ছোঁয়া হল না ভারতের। আর সেই দীর্ঘশ্বাস মিশে গেল গঙ্গাপাড়ের হা-হুতাশে।
হাওড়া সেতুর অদূরে গঙ্গার ছোটেলালঘাটের আখড়ায় রবিবার বিকেলটা অবশ্য দিব্যি ফুরফুরে মেজাজেই শুরু হয়েছিল। এই প্রথম পর পর দু’টো অলিম্পিকে ব্যক্তিগত ইভেন্টে পদক জিতছেন কোনও ভারতীয় ক্রীড়াবিদ। এবং তিনি এক জন কুস্তিগীর। অতএব সুশীল কুমার ফাইনালে উঠতেই ‘জয় বজরঙ্গবলি’ বলে আখড়ার হনুমান মূর্তিতে পালোয়ানদের ঢিপটিপ প্রণামের ধুম লেগে গেল।
বিকেলে গা ঘামানোর শেষে আখড়া-কর্তা জ্বালা তিওয়ারি গা থেকে গঙ্গামাটি মোছারও সময় পাননি। স্ত্রী ঊর্মিলা ‘রে-রে’ করে নিষেধ করছিলেন। পোড়খাওয়া মল্লবীর তবু অনেক দিন বাদে স্ত্রীকে উড়িয়ে দেওয়ার সাহস দেখালেন। ‘‘অলিম্পিক ফাইনালের আগে কোনও কথা নয়!” বলে ঘামে ভেজা শরীরেই আখড়া-লাগোয়া ঘরে ঢুকে টিভি-র সামনে বসে পড়লেন। সঙ্গী তাঁর ছেলে দুর্গেশ আর পুঁচকে থেকে দশাসই নানা চেহারার পালোয়ান।
জ্বালার পালোয়ানি মেজাজের সামনে সাধারণ ভাবে দমে যান না ঊর্মিলা। বাংলার আর পাঁচ জন পালোয়ানের স্ত্রীর মতোই তাঁরও বিশ্বাস, কুস্তি করে ‘পেট ভরে না।’ |
কলকাতার আখড়ায় খুদে পালোয়ান। ছবি: সুমন বল্লভ |
ষষ্ঠীচরণদের হাতি লোফা নিয়ে পদ্য জমে ঠিকই, কিন্তু বাস্তবে সংসার চালাতে এ দেশে যে তাঁদের যথেষ্ট ঝক্কি পোহাতে হয়, তা ঊর্মিলাদের চেয়ে বেশি আর কে-ই বা জানেন? তবু কুস্তিতে ভারতের অলিম্পিক-ফাইনাল বলে কথা! তাই পালোয়ান-স্বামীর আবেগে সায় দিতেই হল! ঊর্মিলা আর কথা বাড়াননি। নিজেও টিভির সামনে এসে বসেন। যদিও খানিক পরই মুচকি হেসে মন্তব্য ছোড়েন, “ও সব পালোয়ানি অনেক দেখা আছে। আমাকে ও সব প্যাঁচপয়জার দেখিও না। অলিম্পিক ফাইনাল বলেই ছাড় দিলাম।”
জ্বালার অবশ্য সে সবে কান নেই। তাঁর মন টিভির দিকে। জাপানি প্রতিদ্বন্দ্বীর প্যাঁচে হরিয়ানভি সুশীল কুমার ধরাশায়ী হওয়ার আগে বার বার একটা কথাই বলছিলেন, “এত দূর উঠে আসাটাই সাংঘাতিক ব্যাপার।” জাতীয় স্তরের প্রাক্তন কুস্তিগীরের আশা, অলিম্পিক-শিরোপাতেই হয়তো ক্রিকেটপাগল দেশটা কুস্তির সাবেক পরম্পরার দিকে ফিরে তাকাবে। কিন্তু বড় অভিমান বাংলা নিয়ে।
পাট, ইরানি হোল্ড, কালাজাং! আখড়ায় সুশীল কুমারের ট্রেডমার্ক সব প্যাঁচের রকমফের নিয়ে বলতে বলতেও জ্বালা তাঁর যাবতীয় জ্বালা-যন্ত্রণা উগরে দিচ্ছিলেন, “ধুর-ধুর বঙ্গালে কুস্তির কোনও ভ্যালু নেই। দিল্লি, কর্নাটক, হরিয়ানা সব খানে কুস্তির কদর। ব্যতিক্রম শুধু গোবর গোহের রাজ্য।’ এ তল্লাটে কুস্তি করে পালোয়ানের খোরাকিই জোটে না। অন্তত ৬-৭ কেজি দুধ-মালাই,
পেস্তা-বাদাম রোজ চাই। কিন্তু বাংলার এক সময়ের অন্যতম সেরা পালোয়ান এখন পুরসভার পাকির্ং-লটের কর্মী। তার ফাঁকে কুস্তির চর্চা। আখড়ার অন্য পালোয়ানরা বেশির ভাগই পেশায় নিরাপত্তারক্ষী, বড়জোর ছোট ব্যবসা করছেন। সবারই এক সুর, এই রোজগারে তো পালোয়ানের পথ্যি জোটানোই দায়!
পালোয়ান শ্রীনাথমল পারিখের নামাঙ্কিত গঙ্গাপাড়ের এই পথ চলা শুরু ১৯৬১ সালে। জ্বালা আফশোস করছিলেন, “আখড়া থেকে দু’টো ছেলেকেও চাকরি দিতে পারিনি। এত বার বেঙ্গল খেলে আমারও কিচ্ছু হল না।”
হল না বলেই, আখড়ায় বিকেলের অনুশীলনের ফাঁকে বৌকে এগিয়ে আসতে দেখে কিছুটা অস্বস্তিতে পড়েছিলেন জ্বালা। তখনই সংবাদমাধ্যমের নাছোড় অনুরোধ, সুশীল কুমারের কৃতিত্বের দিনে ‘পোজ’ দিতেই হবে। জ্বালা বলছিলেন, “ঊর্মিলা কিন্তু এ সব ছবি তোলা দেখলেই রেগে যায়। আগে খবরের কাগজের কাটিং যত্ন করে কেটে রাখত। এখন বলে, ছবি বেরোলে কি পেট ভরবে?” জ্বালার দুই ছেলে দুর্গেশ ও সুরজ তবু বাবার মতো আখড়ার নেশায় মেতেছেন। দুই ভাই-ই বাংলার প্রতিনিধিত্ব করছেন। খবরটা শুনিয়ে ঊর্মিলাই ‘আমার পোড়া কপাল’ বলে হতাশায় মুখ ঢাকলেন।
কুস্তিতে দেশের এত বড় সাফল্যের দিনে বাংলার কুস্তিচর্চার আরও দুই পীঠস্থানও হতাশায় ডুবে থাকল। হেদুয়ায় প্রবাদপ্রতিম গোবর গোহের আখড়া ও জোড়াবাগান পার্কের পঞ্চাননতলা ব্যায়াম সমিতি। এ রাজ্যে কুস্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তার গুমোট কাটাতে পারেনি অলিম্পিক-পদকও। ১৯৫২ সালে হেলসিঙ্কি অলিম্পিকে ব্রোঞ্জ জয়ের আগে পঞ্চাননতলা ব্যায়াম সমিতিতেই অনুশীলন করেছিলেন কে ডি যাদব। তাঁর সমসাময়িক কুস্তিগীর নিরঞ্জন দাস, নির্মল বসুর মতো অলিম্পিয়ানরাও ‘মেড ইন জোড়াবাগান’। কিন্তু হরিয়ানার তরুণের সাফল্যের দিনে অতীতের এই ঘিয়ের গন্ধ ছাড়া কী-ই বা বলার আছে তাঁদের? কুস্তির কোচ নরেশচন্দ্র সাহা আক্ষেপ করছিলেন, “বাঙালি ছেলেরা আজকাল কুস্তিতে আসছেই না!”
কেন আসবে? আদতে গোরক্ষপুরের ভূমিপুত্র হয়েও মনে-প্রাণে ‘বাঙালি’ জ্বালা তিওয়ারির হা-হুতাশ, কোনও সরকারই এ রাজ্যে কুস্তিগীরদের চাকরির কথা ভাবে না। রাত-দিন বৌয়ের মুখ ঝামটাই আমাদের মেডেল।” সুশীল কুমারের রুপো জয়ের দিনেও বিষাদেই ডুবে বাংলার পালোয়ানরা। |