গল্পটা এই রকম। ‘মহাবলী’ সতপালের দুই ছাত্র কুস্তিগিরদের একটা দলের সঙ্গে বেলগ্রেড গিয়েছেন কোনও প্রতিযোগিতার প্রস্তুতি নিতে। চলছে সার্বিয়া রাজধানীর বিশ্ববিখ্যাত ফুটবল ক্লাব ‘রেড স্টার’ ঘুরে দেখার উৎসাহী তোড়জোড়। নিরুত্তাপ শুধু পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চির এক যুবক। ‘রেড স্টার’ দর্শনে আগ্রহীরা তাঁকে যখন জিজ্ঞাসা করেন, “কী হল, তুমি যাবে না?” উত্তর আসে “মেরে দেশ মে ইন্ডিয়া গেট হ্যায়। ওহি দেখা হ্যায়!”
এই হলেন সুশীল কুমার।
ইন্ডিয়া গেট দেখার পরে বিশ্বের আর কোনও বিস্ময় যাঁকে টলাতে পারে না। ভারতীয়ত্বের শিকড় তাঁর এতটাই গভীরে।
রবিবার সুশীল যখন লন্ডনের ভিকট্রি স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে, তখনও তো তাঁর শরীরে আখড়ার মাটির গন্ধ। খেলাধুলোর সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক মঞ্চে তিনি সনাতন ভারতীয় কুস্তির সাফল্যের সুবাস।
অলিম্পিকে জোড়া পদক, বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ-সহ আন্তর্জাতিক বহু প্রতিযোগিতায় সোনা, রাজীব খেলরত্নের সম্মান। দিল্লির সরকারি বাস চালক দিওয়ান সিংহের সন্তান এ ভাবেই হয়ে উঠেছেন দেশের অন্যতম সেরা ক্রীড়াবিদ। এই অবিশ্বাস্য রূপকথার নামই সুশীল। দিল্লি ছাড়িয়ে প্রায় হরিয়ানা ছুঁই ছুঁই নজফগড়ের বাপরোলা গ্রামের এক পালোয়ান পরিবারে যে রূপকথার জন্ম।
বীরেন্দ্র সহবাগের উত্থান বিখ্যাত করেছিল নজফগড়কে। সুশীলের হাত ধরে সে ভাবেই পরিচিতি পাচ্ছে বাপরোলা। একই এলাকার দুই তারকা মধ্যে অবশ্য তেমন আলাপ নেই। কারণটা সম্ভবত ক্রিকেট নিয়ে কুস্তিগিরের গভীর অনাগ্রহ। লিয়নেল মেসি আর বার্সেলোনার একনিষ্ঠ ভক্ত কুস্তির প্রস্তুতিতে নিয়ম করে ফুটবল খেলেন। বাস্কেটবল, ভলিবলও। কিন্তু ক্রিকেট নয়। তবু ভারতের ক্রিকেট-ঈশ্বরের সঙ্গে একটা জায়গায় অদ্ভুত মিল ভারতীয় কুস্তির সব থেকে উজ্জ্বল নক্ষত্রের। সচিন তেন্ডুলকরের মতোই সুশীল কুমারের কাছেও তাঁর খেলাটাই একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান, সর্বোচ্চ সাধনা!
সাধনার শুরুটা হয়েছিল একেবারে শৈশবে। মাত্র চার বছর বয়সে বাবার হাত ধরে যে দিন গ্রামের আখড়ায় পৌঁছেছিলেন ছোট্ট সুশীল। ঠাকুরদা আর বাবা দু’জনেই পালোয়ানি করতেন একটা সময়। সম্পর্কিত ভাই সন্দীপও কুস্তি শুরু করেছিলেন। কিন্তু দরিদ্র পরিবার দুই কুস্তিগিরের খোরাক জোগাতে পারেনি। সন্দীপকে কুস্তি ছাড়তে হয়। হিরে বাছতে ভুল করেনি পরিবার। সুশীলের বাবা দিওয়ান সিংহ এ দিন স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছেন, “লেখাপড়ায় কোনও দিনই আগ্রহ দেখায়নি। তবে চার বছর বয়স থেকেই ওর কুস্তিতে ঝোঁক দেখে মহাবলী সতপালের কাছে নিয়ে যাই।” সুশীলের জন্মের ঠিক এক বছর আগে, ১৯৮২ এশিয়াডে সোনা জিতেছিলেন সতপাল। দিল্লির ছত্রসালে তাঁর আখড়ার তখন বেশ নামডাক। সেটাই হয় সুশীলের ধাত্রীগৃহ। ক্রমশ গুরুর অন্যতম প্রিয় শিষ্য হয়ে ওঠেন নম্র, শান্ত, বিনয়ী ছেলেটি।
মাত্র চোদ্দো বছর বয়সে সুশীলকে পাকাপাকি নিজের অধীনে নেন সতপাল। পরের বছর, ১৯৯৮ সালে বিশ্ব ক্যাডেট গেমসে সোনা জয়ে। ২০০৩-এর এশীয় চ্যাম্পিয়নশিপ, কমনওয়েলথ চ্যাম্পিয়নশিপে জোড়া সোনা। বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে হন চতুর্থ। কিন্তু তার পরের বছর আথেন্স অলিম্পিকে চোদ্দোতম! ২০০৭ বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে সপ্তম স্থান পাওয়ার পরের বছরই অবশ্য সুশীলের জীবনের মোড় ঘুরে যায় বেজিং অলিম্পিকে ব্রোঞ্জ জিতে। একই বছরে মস্কোয় বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে সোনা।
লন্ডন গেমসের প্রস্তুতিও চলেছিল ছত্রসালের আখড়াতে। এখনও সপ্তাহে ছ’দিন সেখানেই থাকেন সুশীল। আর পাঁচ জন কুস্তিগিরের সঙ্গে একই ডর্মিটরিতে। চাইলেই নিজের আলাদা ঘর হতে পারে। সুশীল চান না। “আমাকে দেখেই ছোটরা শিখবে। ওদের সামনে ভুল উদাহরণ তুলে ধরা ঠিক নয়।” ল্যাপটপে সড়গড়। তবে টিভি থেকে ইন্টারনেট, প্রযুক্তির সব ব্যবহারই হয় শুধু কুস্তির উন্নতির স্বার্থে। রাগ সঙ্গীত আর লোকগীতি ভালবাসেন। নিজে গুনগুনও করেন।
সুশীলের আর এক কোচ যশবীর সিংহের কথায়, “সাফল্য সুশীলকে পাল্টে দেয়নি।” সত্যিই বদলাননি সুশীল। প্রচারমাধ্যমে মুখ খোলা না-পসন্দ এখনও। লড়াইয়ের ফাঁকে ম্যাসিওর ছাড়া কথা বলেন না কারও সঙ্গে। আজও মা কমলা দেবীর হাতে তৈরি মাখনই খান তিনি। আজও ছেলে চোট পেলে নিজের কষ্ট হবে, তাই লড়াই দেখেন না মা। শরীরের নমনীয়তা বাড়াতে আজও ভাই অমিতের সঙ্গে বাড়ির সামনে টানানো দড়ি বেয়ে চলে সুশীলের ওঠানামা। আজও রোজ গ্রাম থেকে দুধ আর বাদাম ছত্রসালের আখড়ায় পৌঁছে দেন বাবা। অবশ্য এই পথটুকু তিনি এখন আসেন সাইকেলের বদলে বিদেশি গাড়িতে। পরিবর্তন বলতে এই আর্থিক স্বাচ্ছল্য। সুশীল ক’দিন আগে বলেছিলেন, “একটা সময় গিয়েছে যখন আমার পরিবারের সবার তিন বেলা খাবার জুটতো না।” আর এখন সুশীলের ট্রেনিং আর ডায়েটের খরচই মাসে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা। বদলেছে সতপালের সঙ্গে সম্পর্কটাও। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে গুরুর মেয়ে সাবির সঙ্গে বিয়ে হয়েছে তাঁর। তবে বিয়ের পরেও অনুশীলনের রুটিন বদলায়নি।
নজফগড়ের মানুষের কাছে তিনি ‘পালোয়ানজি’। সহবাগের শহরে সুশীলের নামে ফ্যান ক্লাবও আছে। বেজিংয়ে জয়ের পরে সেখান থেকে এসেছিল ২০০ টিন ঘি, ২০০ কেজি বাদাম আর ১০টা গরু!
ছত্রসাল আখড়ায় বলা হয়, সুশীল নাকি পদক তাড়া করেন। এ বার লন্ডন যাওয়ার আগে বলেছিলেন, “বেজিংয়ের পদকের রংটা বদলে ফেলতে চাই।” সেটা হয়েছে। এখন চোখ রিও-য়। জানিয়েছেন, বাড়ি ফিরে ক’টা দিন নির্ভেজাল বিশ্রাম চান। তার পর... |