ব্যবহারে লাজুক ও শান্ত স্বভাবের বছর তেইশের গৃহবধূর সঙ্গে যে দাগি অপরাধীদের যোগাযোগ রয়েছে, তা ঘুণাক্ষরেও আঁচ করতে পারেননি নিউ টাউন থানার পোড় খাওয়া পুলিশ অফিসারেরা।
শুধু পুলিশ অফিসারেরাই নন, পাঁচ বছর একসঙ্গে থাকার পরেও জা বা ভাসুরও বাড়িতে ডাকাতির ঘটনায় বিন্দুমাত্র সন্দেহ করেননি বাগুইআটির ওই গৃহবধূ সুমন জয়সোয়ালকে।
গত ১৪ জুলাই সন্ধ্যায় জয়সোয়ালদের বাড়িতে ঢুকেছিল পাঁচ জন সশস্ত্র ডাকাত। সুমনের ভাসুর কৃপাশঙ্করের ঘর থেকে সোনার গয়না, নগদ টাকা লুঠ করে পালায় তারা। পরে সুমন জানায়, তাদের ঘরেও লুঠপাট হয়েছে। কৃপাশঙ্করের আর্থিক অবস্থা তাঁর ছোট ভাই সুভাষের চেয়ে ভাল। তাই ডাকাতেরা সেখান থেকে বেশি মালপত্র লুঠ করেছে বলে প্রাথমিক ভাবে মনে করেছিলেন তদন্তকারীরা। পুলিশ জানায়, সুমন এমন ভাবে গোটা ঘটনাটি বলেছিল যে, তাকে কখনওই সন্দেহ হয়নি। তবে কী ভাবে ফাঁস হল সুমনের ভূমিকা?
শুক্রবার বন্দর এলাকার রবীন্দ্রনগর-সন্তোষপুর থেকে নিজামুদ্দিন ওরফে গোরা নামে এক দুষ্কৃতীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। উদ্ধার হয় একটি দেশি পিস্তল এবং কিছু গয়না। তাকে জেরা করতে গিয়ে গোয়েন্দারা জানতে পারেন, মাসখানেক আগে গোরা এবং আরও কয়েক জন দুষ্কৃতী মিলে জ্যাংড়া এলাকায় একটি ডাকাতি করেছে। ওই সূত্র ধরেই বাকি অপরাধীদের ধরতে তল্লাশি শুরু হয়। রাতভর অভিযান চালিয়ে মহম্মদ আনোয়ার, সঞ্জয় বাল্মীকি ওরফে মামা ধরা পড়ে। হাতিয়াড়ার পণ্ডিত বটতলা থেকে পাকড়াও করা হয় সুমনের দুই ভাই শিবকুমার এবং রাজকুমারকেও।
কলকাতা পুলিশ সূত্রের খবর, জেরার মুখে ডাকাতির সঙ্গে সুমনের যোগের কথা জানিয়ে দেয় শিবকুমার এবং রাজকুমার। এক তদন্তকারীর কথায়, “বাড়ির বৌ-ই ডাকাতির সঙ্গে যুক্ত শুনে প্রথমে তাজ্জব বনে যাই। তার পরেই ফের হাতিয়াড়ার পণ্ডিত বটতলায় হানা দেওয়া হয়।” পুলিশ জানায়, ভাইদের খবর শুনে বাপের বাড়ি আসে সুমন। সেখানেই তাকে গ্রেফতার করা হয়। পরে ধৃতদের জিম্মায় নেয় বিধাননগর পুলিশ। কী ভাবে এক গৃহবধুর সঙ্গে আলাপ হল দুষ্কৃতীদের?
তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, মামা নামে ওই দাগি দুষ্কৃতীর সঙ্গে বহু দিন ধরেই সুমনের দুই ভাইয়ের আলাপ ছিল। জেরায় জানা গিয়েছে, তারা ওয়েলিংটনের একটি কারখানায় কাজ করত। সেখানেই রাজকুমারের সঙ্গে আলাপ হয় সঞ্জয়কুমার বাল্মীকি ওরফে মামা নামে ওই ব্যক্তির। নানা অপরাধমূলক কাজের জন্য সঞ্জয়ের নাম পুলিশের খাতায় রয়েছে। সুমন ও তার স্বামী, সুভাষের সঙ্গে সঞ্জয়ের আলাপ হয় রাজকুমারের মাধ্যমে।
কিন্তু শান্ত, লাজুক স্বভাবের সুমন হঠাৎ ডাকাতির পরিকল্পনা করবে কেন? পুলিশ সূত্রের খবর, সুভাষের আর্থিক অবস্থাই ডাকাতির অন্যতম কারণ। তদন্তে জানা গিয়েছে, সুমন প্রায়ই তাদের আর্থিক দুরবস্থার কথা ভাসুরদের জানাত। কৃপাশঙ্করের ব্যবসা ভাল চলায় তাঁদের আর্থিক অবস্থার যে উন্নতি হচ্ছে, সে খবরও রাখত সুমন। তার জা, পুষ্পা নিজের মেয়ের বিয়ের জন্য সোনার গয়না কিনছিলেন বলেও জানতে পেরেছিল ছোট বৌ। পুলিশ জানিয়েছে, এর পরেই পুষ্পার টাকার উপরে নজর পড়ে সুমনের। তবে শুধু সুমনই নয়, সুভাষও ডাকাতির সঙ্গে জড়িত বলে পুলিশের সন্দেহ। সুমনের গ্রেফতারের খবর চাউর হওয়ার পর থেকে আর খোঁজ মিলছে না তার।
পুলিশ জানায়, ভাইদের মাধ্যমে নিয়মিত বাড়ির খবর ডাকাতদের কাছে পাচার করত সুমন। কিন্তু সেই সময়ে সুমনের মধ্যে কোনও ভাবান্তর দেখেনি জয়সোয়াল পরিবার। বাড়ির ছোট বৌ গ্রেফতার হওয়ায় তাই অবাক পড়শিরাও। ছোটখাটো চেহারার, স্বল্পবাক মেয়েটি কী ভাবে এই কাজ করল, তা ভেবে পাচ্ছেন না তাঁরাও।
এ দিন ধৃতদের বারাসত আদালতে তোলা হলে সুমনের ভাই রাজকুমার, ডাকাতির মূল পাণ্ডা সঞ্জয় ও গোরার তিন দিনের পুলিশি হেফাজত হয়। সুমন, শিবকুমার ও আর এক দুষ্কৃতী মহম্মদ আনোয়ারকে ১৪ দিনের জেল হেফাজতের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সুমনের দেড় বছরের মেয়েটি তার সঙ্গেই রয়েছে। |