বাজারে চাহিদা থাকতেও ভর্তুকির টাকায় কোনও ক্রমে টিকে রয়েছে রাজ্য সরকারের ব্লাড-ব্যাগ তৈরির কারখানা।
প্রতি মাসে ৪৫ থেকে ৪৮ হাজার ‘সিঙ্গল ব্লাড-ব্যাগ’ লাগে রাজ্যে। সেখানে ইলেকট্রো মেডিক্যাল অ্যান্ড অ্যালায়েড ইন্ডাস্ট্রিজ-এর অধীনে রাজ্য সরকারের এই নিজস্ব কারখানার উৎপাদন ক্ষমতাই দিনে ২ হাজার। অর্থাৎ, মাস গেলে ৬০ হাজার ব্যাগ তৈরি হতে পারে শুধু ওই কারখানাতেই। এতে এক দিকে যেমন ব্যবসার আয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে সংস্থা, তেমনই সুরাহা হতে পারে রাজ্য জুড়ে ব্লাড-ব্যাগের আকালের।
কিন্তু চাহিদা-জোগানের এমন লোভনীয় সমীকরণ হাতের নাগালে থাকা সত্ত্বেও এত দিন সে ভাবে টনক নড়েনি। তাই এখনও কারখানায় পড়ে নষ্ট হচ্ছে দামি যন্ত্রপাতি। স্রেফ বসে বসে বেতন পাচ্ছেন কর্মীরা। কারখানা চলার একমাত্র শর্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে সাধারণ মানুষের টাকা থেকে আসা ভর্তুকি। আর পাঁচটা রুগ্ণ সরকারি সংস্থার মতোই। হাল ফেরাতে ২০০৮ সালে এক বার অবশ্য এই কারখানা বিক্রির চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু তখন লাল ফিতের ফাঁস আর সমস্ত কর্মীর দায় নেওয়ার ভয়ে টাকা ঢালতে এগিয়ে আসেনি কোনও বেসরকারি সংস্থাই।
এখন ফের এই কারখানা লাভজনক করতে নড়েচড়ে বসেছে রাজ্য। তবে এ বার সরকারি হাতেই তা করতে চাইছে তারা। শিল্প পুনর্গঠন দফতরের সচিব সুব্রত গুপ্ত জানান, যৌথ ভাবে ইলেকট্রো মেডিক্যালের সঙ্গে এই কারখানা চালাতে পারে আর এক সরকারি সংস্থা গ্লুকোনেট। ইতিমধ্যেই প্রকল্পের বাণিজ্যিক সাফল্য ও পুঁজির জোগান সংক্রান্ত রিপোর্ট তৈরি শুরু করেছে তারা। তবে এই সমাধানসূত্র চটজলদি কার্যকর করা সম্ভব হবে না বলেও স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন তিনি। ফলে আপাতত এই রুগ্ণ সংস্থায় টাকা জুগিয়ে যাবে নুন আনতে পান্তা ফুরনো রাজ্য সরকারই।
প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী বিধান রায়ের আমলে তৈরি রাজ্য সরকারি সংস্থা ইলেকট্রো মেডিক্যালের কারখানা রয়েছে দু’টি। তার মধ্যে বি টি রোডের কারখানায় এক্স-রে ফিল্ম ও মেশিন তৈরি হত। ডিজিটাল দুনিয়ার সঙ্গে পাল্লা দিতে না-পারায় এখন যা কার্যত বন্ধ। ব্যবসা বলতে রয়েছে শুধু অন্য সংস্থার ফিল্ম বিক্রি। ব্লাড-ব্যাগ কারখানাটি তৈরি হয় বাম আমলে। সল্টলেক সেক্টর ফাইভে। কিন্তু এই কারখানাও কার্যত বন্ধ হয়ে গিয়েছে প্রায় ৬ বছর আগে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে খবর, কারখানা ফের চালু করতে নেদারল্যান্ডসের সংস্থার কাছ থেকে আমদানি করা হয়েছিল দামি মেশিন। কিন্তু কোটি টাকার সেই যন্ত্র চালু করার জন্য কাজে লাগানো হয়নি সংশ্লিষ্ট সেই বিদেশি সংস্থাকে। ফলে কেনার মাস সাতেক পরে মোড়ক খুলে দেখা যায় ওই মেশিনের কাজ জানা কর্মী এখানে নেই। পড়ে থেকে নষ্ট হয়ে গিয়েছে তার বেশ কিছু যন্ত্রাংশ। পরে নতুন যন্ত্রাংশ কিনে মেশিন সারানোর চেষ্টা করেও ফল মেলেনি। বরং উল্টে জলে গিয়েছে আরও ২০ লক্ষ টাকা। ফি মাসে কারখানার ৪২ জন কর্মীর বেতন বাবদ ৮-১০ লক্ষ টাকা ভর্তুকিও গুনছে রাজ্য সরকার।
কর্মীদের অভিযোগ, যে দক্ষিণ ভারতীয় সংস্থাটি কাঁচামাল সরবরাহ করত, ব্যাগ তৈরির ব্যবসা রয়েছে তাদের নিজেদেরও। ফলে প্রতিযোগীর কাছে কাঁচামাল কেনার মূল্য চুকিয়েছে ইলেকট্রো মেডিক্যাল। খারাপ কাঁচামাল জুগিয়ে বাজারে তাদের নাম ডুবিয়েছে দক্ষিণ ভারতীয় সংস্থাটি।
সব মিলিয়ে ইলেকট্রো মেডিক্যালের এখন নাভিশ্বাস দশা। এত দিন কার্যকরী মূলধনের অভাবে বরাতের টাকা দিয়েই নতুন বরাতের পণ্য কেনা হচ্ছিল। অন্য সংস্থার তৈরি এক্স-রে ফিল্ম ও চিকিৎসা সরঞ্জাম বেচে কিছু টাকা আয় করছিল তারা। কিন্তু ক্রেতারা এখন অনিয়মিত ভাবে দাম মেটানোর কারণে টান পড়ছে সেই টাকাতেও। যেটুকু আসছে, তা-ও চলে যাচ্ছে বেতন দিতে। আটকে যাচ্ছে ভেন্ডরের টাকা। অভিযোগ অনুযায়ী, যার অঙ্ক দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি। আর এই টানাটানির ‘সংসারে’ দুই কারখানা মিলিয়ে শুধু বেতন দিতেই মাসে মোট ২৬ লক্ষ টাকা ভর্তুকি দিতে বাধ্য হচ্ছে রাজ্য সরকার।
এই পরিস্থিতিতে ব্লাড-ব্যাগ কারখানা পুনরুজ্জীবনের মাধ্যমেই সংস্থাটিকে দাঁড় করাতে চাইছে রাজ্য। যদিও সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হওয়া পর্যন্ত সংস্থা টিকিয়ে রাখাই যথেষ্ট বড় চ্যালেঞ্জ হবে বলে কর্মীদের আশঙ্কা।
|